রাজনৈতিকভাবে দেশ ঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে করেন ৫৬ শতাংশ মানুষ। আর ৫২ শতাংশ মানুষ মনে করছেন দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে চলছে না। এ বছরের অক্টোবরে পরিচালিত ‘পালস সার্ভে ২য় ধাপের এক সমীক্ষায় এই চিত্র উঠে এসেছে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) জরিপটি পরিচালনা করে।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-তে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ: মানুষ কি ভাবছে’ শীর্ষক আলোচনা সভায় জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এই সভায় জরিপে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের আশা, উদ্বেগ এবং দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচকবৃন্দ আলোচনা করেন।
এই জরিপে সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৪ হাজার ১৫৮ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। উত্তরদাতাদের ৫৬ শতাংশ মনে করেন দেশ রাজনৈতিকভাবে সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। অন্যদিকে ৩৪ শতাংশ মনে করেন দেশ ভুল পথে যাচ্ছে।
ফলাফলগুলো ২০২৪ সালের আগস্টে করা পালস সার্ভের ১ম ধাপে পাওয়া ফলাফলের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। পূর্ববর্তী সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের ৭১ শতাংশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন ১২ শতাংশ মানুষ।
এ সমীক্ষায় বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে যাচ্ছে কি না- এ ব্যাপারে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে রয়েছে। অন্যদিকে ৫২ শতাংশ মনে করেন, অর্থনীতি সঠিক পথে চলছে না। অর্থ্যাৎ অর্থনীতি নিয়ে জনগণের আশাবাদ আগস্টের তুলনায় অক্টোবরে এসে কমে গেছে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের আগস্টে ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেছিলেন বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে, আর ২৭ শতাংশ মনে করেছিলেন ভুল পথে যাচ্ছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, অক্টোবর মাসে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে জনসাধারণের মতামতে বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে। তা সত্ত্বেও, যেখানে ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা আগস্ট মাসে বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দু’দিক থেকেই দেশ সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশে। অন্যদিকে, আগস্টে ১৭ ভাগ উত্তরদাতা মনে করতেন যে দেশ ভুল পথে যাচ্ছিল। এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে।
দেশের মানুষ মনে করেন, সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু। ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা মূল্যবৃদ্ধি, মন্দাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যাকে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের একদফা আন্দোলনে পরিবর্তিত হওয়ার ব্যাপারে জনগণের সমর্থন কতটুকু স্থানান্তরিত হয়েছে তা বোঝার জন্য জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, আগস্ট মাসে ৮৩ শতাংশ মানুষ আন্দোলনকে সমর্থন করলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এসে এই সমর্থন দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। অন্যদিকে, আগস্ট মাসে ১০ ভাগ মানুষ বলেছেন তারা এ আন্দোলনকে সমর্থন করেননি যা অক্টোবরে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে।
দেশের মধ্যেকার সহনশীলতার কি অবস্থা, তা জানতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, ৩১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন সহনশীলতা হ্রাস পেয়েছে এবং ২০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন সহনশীলতার ব্যাপারটি অভ্যুত্থানের আগে যেমন ছিল, তেমনই আছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে- তা নিয়ে জনগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪০ শতাংশ মনে করেন, এ সরকারকে কমপক্ষে দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে। অন্যদিকে ৪৬ শতাংশ মনে করেন এক বছর বা তার কম সময়ই যথেষ্ট।
উল্লেখ্য, তিন বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে জনসমর্থন আগের তুলনায় কমে এসেছে। এবছরের আগস্টে ৩৮ শতাংশ যেখানে তিনবছর মেয়াদকে সমর্থন করেছিল, সেখানে অক্টোবরে তা কমে হয়েছে ২৪ শতাংশ। অপরদিকে, ৫ শতাংশ মনে করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত অবিলম্বে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া।
বিভিন্ন ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা, বর্জনের ব্যাপারেও সমীক্ষায় জানতে চাওয়া হয়। এব্যাপারে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। অন্যদিকে, ২৪ শতাংশ মনে করেন, সরকার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি এবং ২১ শতাংশ মনে করেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথাযথ চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি। আবার, সরকার কি দৃঢ়ভাবে দেশ চালাচ্ছে—এই প্রশ্নের জবাবে ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, হ্যাঁ, সরকার দৃঢ়ভাবে দেশ চালাচ্ছে। কিন্তু ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতা এই মতের বিপক্ষে।
জরিপে জিজ্ঞাসা করা হলে জানা যায়, ৭৯ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন যে নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চেয়ে দেশ ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারে। অন্যদিকে, ১৫ শতাংশ মানুষ এই মতের বিপক্ষে।
জরিপে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ বর্তমান সরকারের কাজকর্মকে ০ থেকে ১০০ স্কেলে ৬৮ দিয়েছেন। ২০২৪ সালের আগস্টে এই রেটিং ছিল প্রায় ৭৫।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আনু মুহাম্মদ বলেন, জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা চায়, যাতে তারা বুঝতে পারে সরকার কীভাবে এবং কী কী কাজ করে দেশের উন্নতি করবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আমরা জানি যে, বর্তমানে দেশে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে তবে এটাও মনে রাখা দরকার, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র চার মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত সময়কালে একাধিক জটিল সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন বটে। তবে আমরা সকলে মিলে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর আগস্টে মানুষের আশা বেড়েছিল। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই আশা পূরণ না হওয়ায় জনসাধারণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সময় সরকারকে জনগণের এই উদ্বেগের কথা বিবেচনা করতে হবে।