সিরিয়ায় আসাদবিরোধী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর হাতে বাথ পার্টির ৬১ বছরের শাসনের অবসান হলো। ১৯৬৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭১ সালে বাশার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদ পার্টির ভেতরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আমিন আল হাফিজের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন ২০০০ সালে।
২০১১ সালে শুরু হওয়া ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে রবিবার (৮ ডিসেম্বর) বাশার আল আসাদ দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বিদ্রোহীরা দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। গত এক সপ্তাহের একপক্ষীয় যুদ্ধে হুড়মুড় করে বাশারের শাসনের পতন ঘটল। এর মাধ্যমে অবসান ঘটে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে শাসন করা আসাদ পরিবারের।
সিরিয়ার দামেস্কসহ এর আশপাশের অঞ্চল নিয়ে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বিশেষত কেয়ামতের আগের কিছু ঘটনা এ অঞ্চল ঘিরে সংঘটিত হবে। তাই বিভিন্ন হাদিসে এ অঞ্চলকে মুসলিমদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তা ছাড়া ইমাম মাহদি (আ.)-এর অনুসরণ, দাজ্জালের আগমন ও হত্যা, হজরত ঈসা (আ.)-আবির্ভাব, শাসনকালসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় হাদিসে।
‘মুলকে শাম’ বা শাম ভূখণ্ড নবী-রাসুলদের ভূখণ্ড। কোরআন-হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় তার বরকত ও পবিত্রতার বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাসের অগণিত ঘটনাপ্রবাহ তার সঙ্গে জড়িত। মক্কা-মদিনার পরই যার মর্যাদা স্বীকৃত।
ভৌগোলিকভাবে আগের শাম অঞ্চল বর্তমানে কয়েকটি রাষ্ট্রে বিস্তৃত। বর্তমানের সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড প্রাচীন মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই শামের সঙ্গে ভবিষ্যতের ও কেয়ামতপূর্ব অনেক ঘটনা জড়িত রয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) শামের ব্যাপারে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
আল্লাহর অলিদের অবস্থান
হজরত শুরাইহ ইবনে উবাইদ (রহ.) বলেন, হজরত আলী (রা.) ইরাকে অবস্থানকালে তাকে শামবাসীর ব্যাপারে বলা হলো, আপনি তাদের ওপর অভিশাপ করুন! তখন তিনি বলেন, না, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, শাম ভূখণ্ডে আবদালরা (আল্লাহর অলিদের বিশেষ দল) থাকেন। তারা ৪০ জন থাকেন। যখনই তাদের থেকে একজন মারা যান, আল্লাহতায়ালা তার স্থানে অন্য একজনকে রাখেন। তাদের বরকতে বৃষ্টি হয় ও শত্রুর ওপর জয়লাভ হয়। ভবিষ্যতে তাদের উসিলায় শামবাসীর ওপর থেকে আজাব তুলে নেওয়া হবে। -মুসনাদে আহমাদ : ৮৯৬
মুসলিমদের দ্বিতীয় হিজরতভূমি
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, হিজরতের পর আরেকটি হিজরত শিগগিরই সংঘটিত হবে। তখন ভূপৃষ্ঠের সর্বোত্কৃষ্ট মানুষ হবে তারা, যারা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরতভূমিতে (শাম দেশে) অবস্থান করবে। আর পুরো পৃথিবীতে সর্বনিকৃষ্ট মানুষরাই বাকি থাকবে। তাদের ভূমিগুলো তাদের নিক্ষেপ করবে। আল্লাহতায়ালা তাদের অপছন্দ করবেন। তাদের ফেতনার আগুন তাদের বানর ও শূকরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। (তাদের দুশ্চরিত্রের কারণে তারা যেখানেই যাবে সেখানেই ফেতনা লেগে থাকবে)।’ -সুনানে আবু দাউদ : ২৪৮২
ইবনে হাওয়ালা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইসলামি বাহিনী শিগগিরই কয়েকটি দলে দলবদ্ধ হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়েমেনে ও অন্য একটি ইরাকে। ইবনে হাওয়ালা (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি সে যুগ পাই, তখন আমি কোন দলে যুক্ত হব, তা বলে দিন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি শামের বাহিনীতে থাকবে। কেননা তা আল্লাহর পছন্দনীয় ভূমির একটি। সেখানে তিনি তার সর্বোত্কৃষ্ট বান্দাদের একত্রিত করবেন। আর যদি তুমি তাতে যুক্ত না হতে পারলে তুমি ইয়েমেনের বাহিনীকে গ্রহণ করো। আর তোমরা শামের কূপ থেকে পানি গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ আমার জন্য অর্থাৎ আমার উম্মতের জন্য শাম ভূখণ্ড ও তার বাসিন্দাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।’ -সুনানে আবু দাউদ : ২৪৮৩
উম্মতে মুহাম্মদির কল্যাণ সম্পৃক্ত
হজরত মুয়াবিয়া ইবনে কুররা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন শামভূমি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের মাধ্যমে ধ্বংস হবে তখন তোমাদের মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকবে না। আর আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। তাদের যারা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তারা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ -জামে তিরমিজি : ২১৯২
মুসলিম বাহিনীর সেনাছাউনি
হজরত আবু দারদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের ছাউনি হবে ‘গোতা’ শহরে, যা দামেস্ক শহরের পাশে অবস্থিত। এটি শামের উত্কৃষ্ট শহরগুলোর একটি।’ -সুনানে আবু দাউদ : ৪২৯৮
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অচিরেই তোমরা শাম বিজয় করবে। যখন তোমরা সেখানে বসবাসের সুযোগ পাবে তোমরা দামেস্ক নগরীতে থাকবে। কেননা তা যুদ্ধবর্তীকালীন মুসলিমদের আশ্রয়স্থল হবে। আর তাদের ছাউনি হবে ওই দেশের একটি ভূমি, যাকে ‘গোতা’ বলা হয়।’ -মুসনাদে আহমাদ : ১৭৪৭০
হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘খোরাসান ভূমি থেকে কালো পতাকাবাহী দল বের হবে। তাদের কোনো কিছুই প্রতিরোধ করতে পারবে না। যতক্ষণ না তারা তা ‘ইলিয়া’ তথা জেরুজালেমে না পৌঁছে।’ -জামে তিরমিজি : ২২৬৯
উল্লেখ্য, আব্বাসীয় খিলাফতের যুগ থেকে অনেকেই নিজেদের ওই দল বোঝানোর জন্য কালো পতাকা নিয়ে অভিযানে নেমেছে। কেউ বা নিজেকে মাহদিও দাবি করে বসেছে। তবে তাদের এমন দাবি সম্পূর্ণ ভুল ছিল। বরং আল্লাহই ভালো জানেন, তারা কেয়ামতের আগে কোন যুগের ও কারা হবে।
কেয়ামতের আগে মাহদির খেলাফত গ্রহণ
হজরত উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানদের একজন খলিফার ইন্তেকালের পর মতানৈক্য হবে। তখন মদিনাবাসীর একজন ব্যক্তি (মতানৈক্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্য) মক্কায় চলে আসবেন। অতঃপর মক্কাবাসীর অনেক লোক তার কাছে আসবে এবং তাকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের করে এনে মাকামে ইবরাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বায়াত হবে। (তিনিই হলেন ইমাম মাহদি) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শাম থেকে একটি (বাতিল) দলকে পাঠানো হবে। তবে তারা মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে পৌঁছলে ভূমিধসে আক্রান্ত হবে। মানুষ তা দেখার পর শামের আবদালরা ও ইরাকবাসী উৎকৃষ্ট মানুষের দল আসবে। অতঃপর তারা মাকামে ইবরাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বায়াত হবে। অতঃপর কোরাইশ বংশের জনৈক ব্যক্তির উদ্ভব হবে। কালব গোত্র হবে তার মাতুল গোত্র। সে তাদের মোকাবেলায় একটি বাহিনী পাঠাবে। যুদ্ধে মাহদির অনুসারীরা কালব বাহিনীর ওপর বিজয়ী হবে। এ সময় যারা কালব থেকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিতে উপস্থিত হবে না তাদের জন্য আফসোস! মাহদি গনিমতের সম্পদ বণ্টন করবেন ও নবী কারিম (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী মানুষের মধ্যে কার্য পরিচালনা করবেন। আর ইসলাম সারা পৃথিবীতে প্রসারিত হবে। অতঃপর তিনি সাত বছর অবস্থান করার পর মারা যাবেন। আর মুসলিমরা তার জানাজা পড়বে। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, কেউ কেউ হিশাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, ৯ বছর অবস্থান।
দামেস্কে ঈসা (আ.)-এর অবতরণ
হজরত নাউওয়াস ইবনে সামআন (রা.) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে দাজ্জাল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। তাতে হরজত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের ওপর অটল থাকবে।
দীর্ঘ হাদিস বর্ণনার একপর্যায়ে নবী কারিম (সা.) বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহতায়ালা হজরত ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.)-কে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তার শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে সে মারা যাবে। আর তার দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তার শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন, অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন।’ -সহিহ মুসলিম : ২৯৩৭