শয়তানের কাজ
পৃথিবীতে শয়তান মুমিনের প্রধান শত্রু। কোরআন মাজিদে ‘শয়তান’ (এক বচন) শব্দটি ৬৩ বার আর ‘শায়াতিন’ (বহু বচন) শব্দটি ১৮ বার উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের অসংখ্য স্থানে আল্লাহতায়ালা শয়তান সম্পর্কে মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ -সুরা বাকারা : ১৬৮
আল্লাহর অবাধ্য, অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আসার পর শয়তান মানুষকে প্রতারিত করে জাহান্নামে নেওয়ার মিশন শুরু করেছে। শয়তান ও তার দল মানুষকে প্রতারিত করতে যেসব কাজ করে থাকে তার কয়েকটি হলো-
প্ররোচনা দেওয়া : শয়তান হজরত আদম ও হজরত হাওয়া (আ.)-কে প্ররোচনা, ধোঁকা ও প্রলোভন দেখিয়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বলল, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের এ গাছ থেকে নিষেধ করেননি, তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা হয়ে যাও এখানে চিরকাল বসবাসকারী। সে তাদের কাছে কসম খেয়ে বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্খী।’ -সুরা আরাফ : ২১-২১
পথভ্রষ্ট করা : মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস ও প্রবঞ্চনা দ্বারা পথভ্রষ্ট করা এবং আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত করা শয়তানের অন্যতম কাজ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, মিথ্যা আশ্বাস দেব, তাদের নির্দেশ দেব, যার ফলে তারা পশুর কর্ণ ছেদ করবে এবং তাদের নির্দেশ দেব ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে।’ -সুরা নিসা : ১১৯
ধোঁকা দেওয়া : ধোঁকা দেওয়া শয়তানের অন্যতম কৌশল। শয়তান হজরত আদম ও হজরত হাওয়া (আ)-কে ধোঁকা দিয়ে বলল, মানুষের পরিণাম হলো মৃত্যু, তবে এ গাছের ফল যে খাবে সে চিরজীবী হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর শয়তান এ ব্যাপারে তাদের পদস্খলন ঘটাল এবং তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার প্ররোচনা দ্বারা বহিষ্কৃত করল।’ -সুরা বাকারা : ৩৬
মন্দ ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ : শয়তান মানুষের সামনে অশ্লীল ও খারাপ জিনিসকে আকর্ষণীয় ও উত্তম হিসেবে পেশ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই সে (শয়তান) তোমাদের মন্দ ও অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেয়। আর যেন তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলো যা তোমরা জানো না।’ -সুরা বাকারা : ১৬৯
নিজেদের দলভুক্ত করার প্রচেষ্টা : শয়তান মানুষকে বশীভূত করে নিজেদের দলভুক্ত করে নেয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘শয়তান তাদের বশীভূত করে নিয়েছে। অতঃপর আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে। তারা শয়তানের দল। সাবধান, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত।’ -সুরা মুজাদালা : ১৯
সরল পথ থেকে বিমুখ করা : শয়তান মানুষকে সহজ-সরল ও সঠিক পথ থেকে বিমুখ করতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শয়তান বলল, আপনি আমাকে যেমন উদ্ভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্য আপনার সরল পথে বসে থাকব। অতঃপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। আপনি তাদের বেশির ভাগকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।’ -সুরা আরাফ : ১৬-১৭
মানবের শিরা-উপশিরায় বিচরণ : শয়তান আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আদম সন্তানের শিরা-উপশিরায় বিচরণ ও চলাফেরা করে আদম সন্তানকে পথহারা করে। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় বিচরণ করে।’ -সহিহ বোখারি : ১২৮৮
পাপকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলা : পথভ্রষ্ট করতে শয়তানের অন্যতম কৌশল হলো- পাপ কাজকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলা। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে (ইবলিস) বলল, হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করব এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করব। আপনার মনোনীত বান্দারা ছাড়া (তাদের কোনো ক্ষতি আমি করতে পারব না)।’ -সুরা হিজর : ৩৯-৪০
ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা : শয়তান মুমিনের ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ইবাদত নষ্ট করে দেয়, যাতে সে পুণ্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়। হজরত উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, আমি একবার রাসুল (সা.)-এর কাছে আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! শয়তান আমার মধ্যে ও আমার নামাজ ও কিরাতের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাতে জটিলতা সৃষ্টি করে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি যখন তার উপস্থিতি অনুভব করবে, তখন তার কুমন্ত্রণা হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তোমার বাম দিকে তিনবার থু থু ফেলবে।’ -সহিহ মুসলিম
প্রভাব বিস্তার করা : শয়তান আদম সন্তানের ওপর স্বীয় প্রভাব বিস্তার করে। এতে সে নানাভাবে প্রভাবিত করে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আদম সন্তানের ওপর শয়তানের একটি প্রভাব রয়েছে। অনুরূপ ফেরেশতারও একটি প্রভাব রয়েছে। শয়তানের প্রভাব হলো, অকল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সত্যকে মিথ্যায় প্রতিপন্ন করা। আর ফেরেশতার প্রভাব হলো, কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং সত্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি কল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করে সে যেন জেনে রাখে, এটা আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকেই হয়েছে। কাজেই তার উচিত আল্লাহর প্রশংসা করা। আর যে ব্যক্তি অকল্যাণের অবস্থা উপলব্ধি করে, সে যেন অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। অতঃপর হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আয়াতটি পাঠ করে, ‘শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়।’ -সুনানে তিরমিজি
সব মানুষের সঙ্গে শয়তান আছে। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সঙ্গে জিন এবং ফেরেশতাদের মধ্য থেকে কাউকে সঙ্গী নিযুক্ত করা হয়নি।’ সাহাবারা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার সঙ্গেও কি জিন সঙ্গী নিযুক্ত আছে? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ, আমার সঙ্গেও আছে। তবে আল্লাহতায়ালা তার ওপর আমাকে বিজয়ী করেছেন, ফলে সে আমার অনুগত হয়ে গেছে। সে আমাকে কল্যাণকর কাজ ছাড়া অন্যকোনো কাজের পরামর্শ দেয় না।’ -সহিহ মুসলিম