১৩ শ বছরেও জৌলুস হারায়নি দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ
উমাইয়া মসজিদের অবস্থান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে। এটি গ্রেট মস্ক অব দামাসকাস নামেও পরিচিত। এটি শুধুমাত্র একটি মসজিদ নয় বরং পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং অতি মূল্যবান একটি সম্পদ বা স্থাপনা।
বর্তমান বিশ্বে যে কয়টি প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্য আদি অবকাঠামোর ওপর এখনো টিকে আছে, তার মধ্যে অন্যতম এটি। এর বয়স ১৩শ’ বছরের বেশি। এ মসজিদকে ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম পথিকৃত হিসেবে বিবেচনা করা হয় সারাবিশ্বে। এ মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর কবর।
এ ছাড়া ক্রুসেডের সময় জেরুজালেম বিজয়ী বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীসহ তার বংশধরদেরও অনেকের কবর রয়েছে এ মসজিদের পাশে। বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এ মসজিদে বসে কোরআনে কারিমের ব্যাখ্যা করতেন মানুষের কাছে।
যে স্থানে উমাইয়া মসজিদ অবস্থিত, ওই স্থানটি প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশেষ করে মূর্তি পূজারীদের উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মসজিদ নির্মাণের হাজার বছর আগে থেকে বিভিন্ন দেবতার উপাসনা করা হতো এখানে। দীর্ঘকাল ধরে এখানে ছিল রোমনাদের জুপিটার মন্দির। পরে ৩৯১ সালে জুপিটার মন্দিরকে খ্রিস্টান চার্চে পরিণত করা হয়। পরে এ চার্চ হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর নামে উৎসর্গ করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যামন উপাসনালয় এবং পরবর্তীতে মসজিদ নির্মাণের পরে এখানে থাকা অনেক মূল্যবান প্রত্ন নিদর্শন বর্তমানে সিরিয়ার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
৬৩৪ সালে খালিদ ইবনে আল ওয়ালিদের নেতৃত্বে দামেস্ক জয় হয়। ৬৬১ সালে ইসলামি খেলাফত উমাইয়া বংশের অধীনে আসে। এরপর দামেস্ক হয় মুসলিম বিশ্বের প্রশাসনিক রাজধানী। ষষ্ঠ উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদ ৭০৫ সালে এখানে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
এ মসজিদ যখন নির্মাণ করা হয় তখন এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প। ভারত, ইরান, গ্রিস ও মরক্কো থেকে ১২ হাজার দক্ষ কারিগর সংগ্রহ করা হয় এর স্থাপত্যশৈলীর জন্য। এ ছাড়া বাইজানটাইন কারিগরদের নিয়োজিত করা হয় এর মোজাইকের কাজে। ৭১৫ সালে শেষ হয় মসজিদ নির্মাণ।
৭৫০ সালে উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসে এবং ইসলামি খেলাফতের রাজধানী হয় বাগদাদ। আব্বাসীয়দের সময়ও এ মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মিসরের ফাতিমিদের দখলে আসে এ শহর। এরপর আবার তুরস্কের সেলজুক রাজার মাধ্যমে উদ্ধার হয় এ শহর। এরপর ক্রুসেডের সময়ও এ শহরের আধিপত্য নিয়ে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে লড়াই চলে এবং শেষ পর্যন্ত নুরউদ্দিন জঙ্গি দখল করেন এ নগরী। পরে সুলতান সালাহউদ্দিন আইউবী, তার কাছ থেকে মামলুক এবং মামলুকদের কাছ থেকে তুরস্কের উসমানীয়রা ১৫১৬ সালে দখলে নেয় এ নগরী।
দখল-পাল্টা দখলে বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ মসজিদ। বিশেষ করে ১৪০০ সালে তিমুর দামেস্ক নগরী পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দিলে মসজিদের মূল গম্বুজসহ একটি মিনার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। বিভিন্ন সময় এ মসজিদ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি বিভিন্ন সময় মুসলিম শাসকরা এ মসজিদের সংস্কারও করেন। উসমানীয়দের পর সর্বশেষ বড় আকারে এ মসজিদ সংস্কার করেন সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ।
১৩ শ’ বছর পার হলেও এখনো এ মসজিদের আদি অলঙ্করণ এবং সাজসজ্জা অমলীন যা মুগ্ধ করে দর্শকদের। এ মসজিদ সিরিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
এ মসজিদের পাশে অনেক বীরযোদ্ধার কবর রয়েছে। ২০০১ সালে দ্বিতীয় পোপ জন পল পরিদর্শন করেন এ মসজিদ। মসজিদের তিনটি মিনারের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ঈসা মিনার ২৫৩ ফিট।
পারস্য ইতিহাসবিদ ইবনে আল ফকিহ লিখেছেন, ৭০৫ সালে মসজিদ নির্মাণ শুরুর পর খননের সময় এর নিচে একটি গোপন বাক্সে রক্ষিত একটি মস্তক পাওয়া যায়। এ মস্তক হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর বলে বিশ্বাস। খলিফা প্রথম ওয়ালিদ এটি জানার পর তিনি মস্তকটি মসজিদের মধ্যে সমাহিত করে তার ওপর একটি বিশেষ পিলার নির্মাণের নির্দেশ দেন। পরে এ স্থানে মাজার ও গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। হজরত ইয়াহইয়া (আ:)-কে খ্রিস্টানরাও তাদের নবী দাবি করে। সে কারণে এ মসজিদ খ্রিস্টানদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আগে থেকেই এখানে ছিল তাদের চার্চ।