বর্তমান সময়ের সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে প্রাচীনকালে ‘মুলকে শাম’ বলা হতো। শাম মূলত নবী-রাসুলদের ভূখণ্ড। কোরআন-হাদিসের একাধিক জায়গায় এর ফজিলতের কথা এসেছে।
এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যাদের দুর্বল মনে করা হতো তাদেরকেও আমি উত্তরাধিকার দান করেছি, এই ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের যাতে আমি বরকত সন্নিহিত রেখেছি।’ -সুরা আরাফ : ১৩৭
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা এর বরকত সম্পর্কে বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনকারী।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ১
সব মোফাসসির এ বিষয়ে একমত যে, উল্লেখিত আয়াতে ‘পবিত্র ভূমি’ এবং ‘বরকতময় ভূমি’ দ্বারা শামের ভূমিই উদ্দেশ্য।
আর আয়াতে বরকত দ্বারা কেউ বেলেছেন, এখানে দুনিয়ার বরকত উদ্দেশ্য। যেমন- এই পবিত্র ভূখণ্ড সর্বদা অধিক পরিমাণে আহার্য, ফলমূল, নদী-নালা, খাদ্যশস্য ও রিজিকের প্রশস্ততায় পরিপূর্ণ থাকবে। আর কেউ বলেছেন, এখানে বরকত দ্বারা দ্বিনের বরকতে ধন্য হওয়া উদ্দেশ্য। কারণ এখানে বহুসংখ্যক নবী-রাসুল বসবাস করেছেন, এখানেই ফেরেশতারা তাদের কাছে আসমানি অহি নিয়ে অবতরণ করেছেন।
তবে বিশুদ্ধ মত হলো, এখানে দ্বিন-দুনিয়া উভয় দিকের বরকতই রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, নবী কারিম (সা.) শামের জন্য দোয়া করে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের শাম দেশে ও ইয়েমেনে বরকত দান করুন।’ -সহিহ বোখারি : ১০৩৭
তা ছাড়া বরকতময় এই ভূমিকে আল্লাহতায়ালা অনেক মর্যাদা দান করেছেন। তার কয়েকটি হলো-
হাশরের ময়দান হবে শাম
ইমাম কুরতুবি, ইবনে কাসির ও ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, শাম হলো হাশরের ভূমি। প্রথমবার ইহুদিদের শামে বহিষ্কার করার দ্বারা প্রথম হাশর সংঘটিত হয়েছে।
আর দ্বিতীয়বার সেখানেই সমগ্র মানবজাতির জন্য হাশরের ময়দান হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, হাকিম বিন মুয়াবিয়া (রহ.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেখানেই তোমাদের হাশর হবে (তোমরা একত্র হবে)। সেখানেই তোমাদের হাশর হবে। সেখানেই তোমাদের হাশর হবে। তখন লোকেরা আরোহী, পদাতিক ও অধঃমুখী এই তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। ইবনে বুকাইর (রহ.) বলেন, সেখানেই তোমাদের হাশর হবে বলার সময় তিনি শাম দেশের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। -মুসনাদে আহমদ : ৩৩/২১৪)
যেখানে ফেরেশতারা নিজের ডানাকে ছড়িয়ে দেন
ফেরেশতারা শামের ওপর নিজের ডানা দিয়ে আবৃত করে রাখেন, যা এই ভূখণ্ডের মাহাত্ম্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। হজরত জায়েদ বিন সাবেত (রা.) বলেন, আমি নবী কারিম (সা.)-কে বলতে শুনেছি, শামের জন্য সৌভাগ্য, শামের জন্য মারহাবা! আমি বললাম, শামের জন্যই কেন? তিনি উত্তর দিলেন, ফেরেশতারা শামের ওপর নিজের ডানা ছড়িয়ে দেন। -জামে তিরমিজি : ৩৯৫৪
আল্লাহতায়ালা শাম ও তার অধিবাসীদের দায়িত্ব নিয়েছেন
ইবনু হাওয়ালা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শিগগিরই ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটবে, যখন জেহাদের জন্য তিনটি সেনা দল গঠিত হবে- সিরিয়ার সেনাবাহিনী, ইয়েমেনের সেনাবাহিনী ও ইরাকের সেনাবাহিনী। ইবনু হাওয়ালা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি সেই যুগ পেলে আমার জন্য কোন দলের সঙ্গী হওয়া মঙ্গলজনক মনে করেন? তিনি বললেন, তুমি অবশ্যই সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। কেননা তখন এই এলাকাই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম গণ্য হবে। আল্লাহ তার সত্কর্মশীল বান্দাদের এখানে একত্র করবেন। আর তুমি সিরিয়া যেতে রাজি না হলে অবশ্যই ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর সঙ্গী হবে। তোমাদের নিজেদের এবং তোমাদের কূপগুলো থেকে পানি উত্তোলন করো। কেননা মহান আল্লাহ আমার অসিলায় সিরিয়া ও এর অধিবাসীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। -সুনানে আবু দাউদ : ২৪৮৩
শাম হবে কোরআন ও ইসলামের ঘাঁটি
হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি (দিব্যদৃষ্টি বা স্বপ্নে) দেখলাম যে কিতাবুল্লাহকে আমার বালিশের নিচ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। অতঃপর আমি স্পষ্টরূপে দেখলাম যে তা যেন এক উজ্জ্বল আলোতে রূপান্তরিত হলো, যার উৎস শাম থেকে। জেনে রেখো! যখন ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে তখন ঈমান শামেই অবস্থান করবে এবং কিতাবুল্লাহ এবং ইসলামের মজবুত ঘাঁটিও সেখানেই থাকবে। আর শামবাসীরা তার হেফাজতে অবিচল থাকবে। -মুসতাদরাকে হাকিম : ৫/৭১২-১১৩
আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত দল শামে অবস্থান করবে
নবী কারিম (সা.)-এর বর্ণিত সাহায্যপ্রাপ্ত বিজয়ী দলটি শামেই অবস্থান করবে। হজরত মোয়াবিয়া ইবনু কুররা (রহ.) তার বাবা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন শামবাসীরা খারাপ হয়ে যাবে তখন তোমাদের আর কোনো কল্যাণ থাকবে না। তবে আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সব সময়ই সাহায্যপ্রাপ্ত (বিজয়ী) থাকবে। যেসব লোক তাদের অপমানিত করতে চায় তারা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। -জামে তিরমিজি : ২১৯২
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পশ্চিম দেশীয়রা বরাবর হকের ওপর বিজয়ী থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। -সহিহ মুসলিম : ৪৮৫২
ইমাম নববি পশ্চিম দেশীয়ের ব্যাখ্যা করেছেন, আরব বা শামবাসী। -মুখতাসারু শরহে মুসলিম : ৫/১৮৫
ইমাম আহমদ ও শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এই মতটি সমর্থন করেছেন।
শামে অবস্থানের জন্য নবীর অসিয়ত
নবী কারিম (সা.) তার উম্মতকে শামে অবস্থানের জন্য অসিয়ত করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের আগে হাজরামাউত সাগর বা এলাকা থেকে আগুন বের হয়ে মানুষকে এক জায়গায় একত্র করবে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তাহলে তখন আমাদের প্রতি আপনার নির্দেশ কী? তিনি বললেন, তখন শামের ভূমিকে আঁকড়ে ধরবে। -মুসনাদে আহমদ : ৯/১৪৫
শাম সর্বোত্তম আবাসভূমি
নবী কারিম (সা.) শামের প্রশংসা করেছেন এবং তাকে সর্বোত্তম আবাসভূমি বলে আখ্যা দিয়েছেন। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যুদ্ধের দিন মুসলিমদের শিবির স্থাপন করা হবে ‘গূতা’ নামক শহরে, যা সিরিয়ার সর্বোত্তম শহর দামেস্কের পাশে অবস্থিত। -সুনানে আবু দাউদ : ৪২৯৮
শাম হলো ঈসা নবীর অবতরণের স্থান
হজরত ইসা ইবনে মারইয়াম (আ.)-এর অবতরণের স্থান হলো- শাম। নাওয়াস বিন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা ঈসা ইবনে মারইয়ামকে প্রেরণ করবেন। তিনি দুজন ফেরেশতার কাঁধের ওপর ভর করে ওয়ারস ও জাফরান রঙের জোড়া কাপড় পরিহিত অবস্থায় দামেস্ক নগরীর পূর্ব দিকের উজ্জ্বল মিনারে অবতরণ করবেন। -সহিহ মুসলিম : ৭২৬৩
শামেই আল্লাহর শত্রু দাজ্জালকে হত্যা করা হবে
শামেই ঈসা (আ.)-এর হাতে দাজ্জাল নিহত হবে। হাদিস শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেন, যখন মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে এবং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হতে শুরু করা মাত্র নামাজের সময় হবে। অতঃপর ঈসা (আ.) অবতরণ করবেন এবং নামাজে তাদের ইমামতি করবেন। আল্লাহর শত্রু (দাজ্জাল) তাকে দেখামাত্রই বিচলিত হয়ে যাবে, যেমন- লবণ পানিতে মিশে যায়। যদি ঈসা (আ.) তাকে এমনিই ছেড়ে দেন তবে সে-ও নিজে নিজেই বিগলিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য আল্লাহতায়ালা হজরত ঈসা (আ.)-এর হাতে তাকে হত্যা করবেন এবং তার রক্ত ঈসা (আ.)-এর বর্শায় তিনি তাদের দেখিয়ে দেবেন। -সহিহ মুসলিম : ৭১৭০
শাম খাঁটি মুমিনদের বাসস্থান
খাঁটি মুমিনদের বাসস্থান হলো শামের পবিত্র ভূমি। হজরত সালামা বিন নুফাইল (রা.) বলেন, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, জেনে রেখো! মুমিনদের বাসভূমির উৎস হবে শাম। -মুসনাদে আহমদ : ২৮/১৬৫
কেয়ামতের আগে শাম হবে নিরাপদ ও ফেতনামুক্ত
কেয়ামতের আগে শাম নিরাপদ ও ফেতনামুক্ত থাকবে। ইমাম ইবনে আসির (রহ.) বলেন, ইসলামের মূল উৎস হবে শাম। যেন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ফেতনার যুগের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অর্থাৎ শাম তখনো নিরাপদ থাকবে এবং মুসলিমরা সেখানে ফেতনামুক্ত থাকবে। -আন নিহায়া ফি গরিবিল : ৩/২৭১