বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান বলেছেন, রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যেতে উসখুস করছে, আমরাও নিজ পেশায় ফিরে যেতে চাই। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।
শনিবার (২ নভেম্বর) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত সংস্কার ও টেকসই উন্নয়নের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, আমাদের কাছে প্রত্যাশা আকাশচুম্বি, মানুষ মনে করছে আমাদের হাতে জাদুর চেরাগ রয়েছে, সব বদলে ফেলতে পারবো। আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছি, কোষাগারে টাকা নেই, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে দেনা রয়েছে।
তিনি বলেন, অন্য সরকারের সঙ্গে এই সরকারের পার্থক্য কি, সরকার হতে গেলে ভোট করতে হয়, সেখানে টাকা লাগে, পেশিশক্তি লাগে, নানান বিষয় থাকে। তাই সরকার কায়েমি স্বার্থের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। আর আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছি কায়েমি স্বার্থের কাছে দায়বদ্ধ না। আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হাজারের ওপর নিহত এবং আহতদের প্রতি দায়বদ্ধ। আমরা তাদের কথা মাথায় রেখে কাজ করছি।
তিনি আরও বলেন, সরকার হচ্ছে এক প্রকার আমানত। জনগণের টাকা খরচ করলেন তাদের কথা মাথায় রাখতে হবে। আমরা কোন প্রকল্প নিলে মানুষের কাছে যাচ্ছি, তাদের মতামত নিচ্ছি। বাড়ি যাওয়ার প্রকল্প বাতিল করে দিচ্ছি, আমরা জনগণের চাওয়া অনুযায়ী প্রকল্প নিচ্ছি। যতটা সম্ভব দুর্নীতি কমানোর চেষ্টা চলছে। আর কেনাকাটা হবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
ড. ফাওজুল কবির খান বলেন, সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। বিদ্যুতের গ্যাসের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের আপত্তি ছিল। আগের সরকার বিইআরসি আইন পরিবর্তন করে নির্বাহী আদেশে দাম বৃদ্ধি করে। আমরা সে পথে যাবো না। দামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিইআরসি। ২০১০ সালের বিশেষ বিধান (দায়মুক্তি আইন) বাতিল করা হয়েছে। এখন দরপত্র হবে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেট্রোরেলের প্রধান হতে হলে তাকে সাবেক সচিব হতে হবে। আমরা বলেছি তার প্রয়োজন হবে না। দেশ-বিদেশে মেট্রোরেল পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকলেই হবে। পিজিসিবির বোর্ড চেয়ারম্যান করা হয়েছে একজন অধ্যাপককে।
জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ হাজার কোটির টাকার এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এটা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে যদি দেশীয় গ্যাসের রিজার্ভ না বাড়ে। গ্যাসের মজুদ বাড়াতে বেশি করে কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রতিদিন অনেক দুর্নীতি অনিয়মের রিপোর্ট পাচ্ছি। আমি যদি শুধু এগুলোর পেছনে ছুটি তাহলে অন্যকাজ করা কঠিন হবে। দুর্নীতি অনিয়মের পাশাপাশি দিক নির্দেশনামূলক রিপোর্ট চাচ্ছি। যাতে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার শাহাদাৎ আলী বলেন, বলা যায় ৯৯ শতাংশ প্রকল্প ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিচার বিশ্লেষণ করার সুযোগ ছিল না। যে কারণে মানুষের প্রত্যাশা পুরণ হয়নি এবং রিটার্ন আসছে না।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইকোনমিক রিসার্চ প্লাটফর্মের ডিরেক্টর ড. একেএম আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে, তবে কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানের এক জরিপে (২০১৯ সাল) দেখা গেছে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫তম। উন্নয়নে প্রাথমিক জ্বালানি খাত সেভাবে গুরুত্ব পায়নি, জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেকার বসে থাকছে, যে কারণে পল্লী এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম বলেন, ফ্লাইওভারের দর্শন ষাটের দশকের দর্শন। যারা তখন না জেনে করেছে, অনেকে ভেঙে ফেলছে। আমরা সেই ভুল পথে হাঁটছি। আমরা বলেছি, লো কস্ট, কোথাও কোথাও নো কস্ট কিন্তু তবু হতো না। যেভাবে পঁচন ধরেছে, এটাকে টেনে তোলা খুব কঠিন।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি আক্তার মাহমুদ বলেন, ঢাকার ফুটপাত কেটে ছোট করে রাস্তা করা হচ্ছে, ৩২ শতাংশ লোকসংখ্যা পায়ে হেঁটে চলাচল করে। তাদের বিষয়ে মনযোগ নেই, মনযোগ সড়ক কেন্দ্রিক। এটাকে সঠিক উন্নয়ন বলতে পারি না।
সিপিডির রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিগত সরকারের অপরিকল্পিত বিনিয়োগের দায়ভার এই সরকারকে বহন করতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারে কার্যকর উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি, বিইআরসিকে কার্যকর করার প্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি, এটা ভালো উদ্যোগ। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি ঠিকাদার প্রজেক্ট প্রপোজাল রেডি করেন, এটাও বড় সমস্যা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার অবকাঠামো উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে। এতদিন এসব বিষয়ে কথা বলা যায়নি, আজকে বলা যাচ্ছে এটাই ছাত্র আন্দোলনের সুফল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, আমরা দেখেছি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি সেভাবে আগায়নি, কিছু নব্যধনী তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের সুবিধা সেভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। যে কারণে প্রায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায়।
বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি রোডম্যাপ দিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিএসআরএফ সভাপতি ফসিহ উদ্দিন মাহতাবের সভাপতিত্বে সেমিনার সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মাসউদুল হক। সিইএবির চিফ অ্যাডভাইজার কি চাংলিয়ান, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড শরমিন্দ নিলোর্মী আলোচনায় অংশ নেন।