পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ১২২তম জন্মবার্ষিকী আজ
‘ওই খানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে/ তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’ বা ‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে/ গাছের ছায়া লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়’ কিংবা বাবু সেলাম বারে বার, আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু বাড়ি পদ্মার পাড়’ - এমন শত কবিতা, গল্প, নাটক আর গানের মাধ্যমে পল্লী মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরে যে কবি পেয়েছিলেন পল্লীকবির উপাধি, সেই পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ১২২তম জন্মবার্ষিকী আজ।
বুধবার (১ জানুয়ারি) কবির জন্মদিন উপলক্ষে অম্বিকাপুরের গোবিন্দপুরে তার সমাধিস্থলে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
১৯০৩ সালের ১লা জানুয়ারি ফরিদপুর শহরতলীর কৈজুরী ইউনিয়নের ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা নিঝুম পাড়া গাঁ তাম্বুলখানা গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কবি জসীম উদ্দীন। কবির বাবার নাম আনছারউদ্দীন, মায়ের নাম আমেনা খাতুন।
কবির পূর্ণ নাম মোহাম্মাদ জসীম উদ্দীন মোল্লা হলেও তিনি জসীম উদ্দীন নামেই পরিচিত। তার বাবার বাড়ি ফরিদপুর শহরতলীর অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে।
বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ও জসিম ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোঃ কামরুল হাসান মোল্লা, পুলিশ সুপার আব্দুল জলিলসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হয়।
এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইয়াছিন কবিরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল হাসান মোল্লা, পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল, কবি পুত্র খুরশিদ আনোয়ার, ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের সভাপতি প্রফেসর এম এ সামাদ, প্রফেসর আলতাফ হোসেন, মফিজ ইমাম মিলন প্রমুখ।
ব্যক্তি জীবনে ১৯৩৯ সালে মমতাজ বেগমকে বিয়ে করেন। কবির ৪ ছেলে কামাল আনোয়ার, ড. জামাল আনোয়ার, ফিরোজ আনোয়ার ও খুরশীদ আনোয়ার, ২ মেয়ে হাসনা জসিম উদ্দীন মওদুদ ও আসমা এলাহী তারা সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ছিলেন।
কবির শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফরিদপুর শহরের হিতৈষী স্কুলে। সেখানে প্রাথমিক শেষ করে তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯২১ সালে ম্যাট্রিক, ১৯২৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তিনি ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬১ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ছোট বেলা থেকেই কাব্য চর্চা শুরু করেন। কবির ১৪ বছর বয়সে নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তৎকালীন কল্লোল পত্রিকায় তার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাখালী। এরপর তার ৪৫টি বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়া পল্লী কবির অমর সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে- নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, এক পয়সার বাঁশি, রাখালী, বালুচর প্রভৃতি।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), ১৯৬৮ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট উপাধি, ইউনেসকো পুরস্কার, ১৯৭৬, বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একজন দৃঢ় সমর্থক। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাও ছিলেন।১৯৭৬ সালে ১৪ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান কবি।
মৃত্যুর পর কবির স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে তার বাড়ির পাশে অম্বিকাপুরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অর্থায়নে প্রায় ৪ একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন সংগ্রহশালা।
উল্লেখ্য, কবির জন্মবার্ষিকীতে এ বছর এখনো ‘জসীম পল্লীমেলা’ আয়োজনের দিনক্ষণ নির্ধারণ হয়নি। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে অম্বিকাপুরে কবির বাড়ির প্রাঙ্গণে ১ জানুয়ারি থেকে কুমার নদীর তীরে মাসব্যাপী জসীম মেলার আয়োজন শুরু হয়।
মেলায় চারু ও কারুপণ্য ছাড়াও আসবাবপত্র ও বিভিন্ন গৃহস্থালী পণ্যের সামাহার ঘটে। নির্মল বিনোদনের জন্য নাগরদোলা, সার্কাস এমনকি প্রথমদিকে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাও মঞ্চস্থ হতো। এছাড়া প্রতিদিন মেলার মাঠ প্রাঙ্গণে জসীম মঞ্চে গান, নাচ, নাটকসহ বিভিন্ন লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। ফরিদপুর ছাড়াও এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে জসীম মেলার বিশেষ আবেদন রয়েছে।