যুব সমাজকে উন্নয়নের শক্তিতে রূপান্তরে প্রয়োজন বিনিয়োগ

  • মুহম্মদ র ই শামীম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

-দক্ষ যুব সম্পদ গড়তে প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিকল্প নেই। ছবি: সংগৃহীত

-দক্ষ যুব সম্পদ গড়তে প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিকল্প নেই। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ এখন জনমিতিক সুবিধার সময়কাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট) পার করছে। ফলে নতুন দেশ গঠনে যুব সমাজের গুরুত্বও বেড়েছে বহুলাংশে। বলা যেতেই পারে যে, জনমিতিক এই সুবিধা আমাদের কাজে লাগানোর নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান। প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ছাত্রদের অবদানের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন ‘... ছাত্ররাই আমার প্রাথমিক নিয়োগকর্তা।’ এ কথা থেকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট যুব সমাজের গুরুত্ব নিশ্চিতভাবে বুঝা যায়।

সত্যিকারর্থে দেশ গঠনে যুব সমাজের মধ্যে নতুন ধারার এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির মূলশক্তিই হলো সবচেয়ে কর্মক্ষম যুব সমাজ। একটি দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের ভরপুর থাকার চেয়েও অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাষ্ট্রের সুনাগরিক ও দক্ষ যুব সম্পদ। শুধু অর্থনৈতিক নয় একটি রাষ্ট্রের দুর্দিনে যুব সমাজই জীবন দিয়ে দেশ-জাতিকে রক্ষায় এগিয়ে আসে, তার প্রমাণ ’২৪ আমরা দেখেছি। সারা বিশ্বে জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে একটি গণঅভ্যুত্থান প্রথম সংঘটিত হয়েছে আমাদের দেশেই (ইউকিপিডিয়া’২৪)।

বিজ্ঞাপন

আমরা জানি, দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই যুব। এরমধ্যে বর্তমানে যাদের বয়স ১২-২৭ বছরের মধ্যে তাদের জেন-জি প্রজন্ম বলা হয় অর্থাৎ যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। আমেরিকার একটি নির্দিষ্ট প্রজন্মকে জেন-জি বলা হলেও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের একই প্রজন্মকে বোঝাতে বর্তমানে প্রায়ই এই শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে।

এরা হল প্রকৃত প্রথম ডিজিটাল নেটিভ জেনারেশন। এদের অধিকাংশই স্ট্রিমিং কন্টেন্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক জনপ্রিয়তার সময় বেড়ে ওঠেছে। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও কর্মকান্ড ইন্টারনেট নির্ভর, শব্দচয়ন, কথাবলা, আচার-আচরণ, ড্রেস আপ ও ভাষা ব্যবহার আগের প্রজন্ম থেকে ভিন্ন। সবচেয়ে বড় বিষয়, এরা কথা বলতে ভয় পায় না।

বিজ্ঞাপন

আন্দোলনে বিভিন্ন স্লোগান ও পরবর্তীতে তাদের আঁকা নানা গ্রাফিতিতেও তারা তাদের স্মৃতিকে ভিন্ন ক্যালিওগ্রাফিক দৃশ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই জেন-জি প্রজন্মের দুইজন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা পরিষদেও নিজেদের যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছেন।

সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় জানা গেছে,বাঁধা-ধরা চাকরির চেয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিভার বিকাশে তাদের আগ্রহ বেশি। সমীক্ষা মতে শতকরা ৭৬ জনই কারো অধীনে কাজ ও কর্মজীবনে আগ্রহী নয়। বেশির ভাগই নিজেই নিজের বস হতে চান।

কিন্তু আমাদের এখনো বিপুল সংখ্যক যুব, যাদের বয়স ১৫-২৪ বছর বয়সী তারা, কোনো প্রশিক্ষণ, শিক্ষা কার্যক্রম ও কর্মসংস্থানের আওতার মধ্যে নেই। এই জনগোষ্ঠীকে সংক্ষেপে এনইইটি (NEET- Not in Education Employment বা any Sorts of Training) বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই হার অনেক বেশি অর্থাৎ শতকরা ৩৯.৮৮ শতাংশ এনইইটি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা।

বাংলাদেশের এই হার বৈশ্বিক হারের প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্বে গড় এনইইটি জনগোষ্ঠী শতকরা ২১.৭ ভাগ। (ILO: 2023) আইএলও এর তথ্য অনুযায়ী ১৫-২৪ বছর বয়সী শ্রমশক্তির শতকরা ১৫.৭ ভাগ এখনো বেকার, যা বিশ্বের গড় বেকারত্ব হারের (১৩.৮%) এর চেয়ে বেশি। এই জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ, শিক্ষা কার্যক্রম ও কর্মসংস্থানের আওতায় আনা কঠিন এখন চ্যালেঞ্জ।

ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (ওয়াইডিআই) এরক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। যুব কার্যক্রমের জন্য প্রতিটি দেশের জন্য ওয়াইডিআই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুব উন্নয়নে সম্পৃক্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এর অগ্রগতি ট্র্যাক করার জন্য গবেষক, নীতি নির্ধারক এবং যুব সমাজের জন্য এটি একটি মূল্যায়ন টুলস। ২০২৩ সালে গ্লোবাল ইয়ুথ ডেভলপমেন্ট ইনডেক্স দ্বারা (ওয়াইডিআই) ১৮৩টি দেশের যুব উন্নয়ন অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়।

৫৬টি কমনওয়েলথভুক্ত দেশের ৫০টি দেশসহ মোট ১৮৩টি দেশের যুব উন্নয়ন অগ্রগতি পরিমাপ করা হয়। এক্ষেত্রে মূলত যুব উন্নয়ন কার্যক্রমের ৬টি বিষয় কভার করা হয়ে থাকে : যেমন-শিক্ষা, কর্মসংস্থান সুযোগ ও সমতা, অর্ন্তভুক্তি, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক ও নাগরিক অংশগ্রহণ। ২০২৩ সালে ওয়াইডিআই অনুযায়ী বিশ্বের টপ র‌্যাকিং দেশ হিসেবে আছে সিঙ্গাপুর।

এরপরেই আছে ডেনমার্ক, পর্তুগাল, আইসল্যান্ড ও স্লোভানিয়া। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শুধুমাত্র পাকিস্থান ও আফগানিস্থানের ওপরে আছে। এ থেকে বুঝা যায় যুব উন্নয়ন কার্যক্রমে আমরা এখনো অনগ্রসর অবস্থায় আছি। বিগত ১২ বছরে বৈশ্বিকভাবে (২০১০-২০২২), গড় ওয়াইডিআই সূচক ২.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ওয়াইডিআই দ্বারা মূলত বিশ্বের ১.৮ বিলিয়ন যুব সমাজের জন্য যুব উন্নয়ন কার্যক্রমের মূল্যায়ন,পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুব সমাজের অবস্থান, তাদের অবদান, অবদানের স্বীকৃতি ও সহায়তার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার অর্জনকে সহায়তা করে। বিশেষ করে পলিসি নির্ধারণ ও যুবদের নিয়ে গবেষণার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বেকারত্ব কোন পথে

দেশে যুব সমাজের বেকারত্ব দূরীকরণ অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তির সর্বশেষ ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা সাত কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার। এই সংখ্যার মধ্যে কাজে আছেন সাত কোটি ৪ লাখ ৭০ হাজার জন। দেশে বাকি কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৮০ হাজার। ২০২৩ সালের ৪র্থ কোয়ার্টারের তথ্যানুযায়ী বেকারের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫০ হাজার। তবে বেকারত্বের এই হিসাবের পদ্ধতিগত মত নিয়ে অনেকের দ্বি-মত আছে।

অন্যদিকে আইএলও’র হিসাব বলছে, দেশে বেকারের সংখ্যা তিন কোটি। দেশে যুব সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশই মনে করেন পড়াশুনা শেষে তারা চাকরি পাবেন না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকেন বলে বিআইডিএসের গবেষণায় জানা গেছে। গরীব শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মনে করেন চাকরি পাবেন না। এতে বুঝা যায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উদ্যোগ

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর দেশের ১৮-৩৫ বছর বয়সী যুবদের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তা, নেতৃত্ব বিকাশ, যুব উদ্যোক্তা তৈরি ও আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রায় তিন লাখ যুবকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় আনে।

অন্যান্য প্রকল্পের আওতায় আরও এক-দুই লাখ যুব বছরে প্রশিক্ষণ পায়। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে EARN: Economic Acceleration and Resilience for NEET Project নামক নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় নয় লাখ এনইইটিভুক্ত যুবনারী ও যুবককে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ এবং ২০ লক্ষ যুব পরোক্ষভাবে এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী করা হবে।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সব সময়ই যুবদের চাহিদা বিবেচনায় কাজ করে থাকে। জেন-জি প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণে তাই যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ‘শিক্ষিত কর্মপ্রত্যাশিদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ফ্রিল্যান্সিং পেশায় বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয়।

চ্যালেঞ্জসমূহ ও করণীয়

বাংলাদেশে কর্মপ্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্মুখের চ্যালেঞ্জ এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। একদিকে জনমিতিক কারণে যুবদের আধিক্যের সুখবর যেমন আছে অপরদিকে অর্থনীতির জন্য এই সুযোগ কাজে লাগানোর কঠিন চ্যালেঞ্জও আমাদের সামনে। যদি এই বিপুল সংখ্যক যুবদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না যায়, তবে তা হবে আমাদের অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত।

দক্ষতা বৃদ্ধি ও কাজের ক্ষেত্র তৈরি, শিক্ষায় পরিবর্তন, বিদেশি ভাষায় জ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ চাহিদা পূরণের বড় চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের সামনে। এখনো আমাদের যুব সমাজের প্রধান সমস্যাই দক্ষতার অভাব। এই কারণে দেশ ও বিদেশে যুব সমাজের অনেকেই কাজ পায় না। পেলেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়।

অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে যারা বিদেশগামী হতে চায় তারাও অনেক সময় নিজেদের উপযুক্ত দক্ষতা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েই বিদেশ চলে যায়। ফলে দেশ কাঙ্খিত রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হয়। আমাদের প্রশিক্ষণগুলোকে তাই জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। এছাড়া বিদেশি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

যুবদের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট দেশের ভবিষ্যত বিনির্মাণের বিনিয়োগ। অথচ দেশের যুব কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটি। বর্তমানে আমাদের মোট জাতীয় বাজেটের শুন্য দশমিক ২৭ শতাংশ বাজেট যুব ও ক্রীড়া বাজেটের জন্য বরাদ্দ। এক্ষেত্রে যুবদের জন্য বাজেট বৃদ্ধি ও পৃথক যুব বাজেটের দাবি দীর্ঘদিনের।

বাজেট প্রণয়নে যুবদের মতামত গ্রহণও আবশ্যক। আর মানবসম্পদ উন্নয়নের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় অংশই হলো যুব সমাজ। যুব মানবসম্পদের উন্নয়নে বিনিয়োগ মানেই একটি দেশের ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। যুবসম্পদ খাতে বিনিয়োগই শুধুমাত্র যুব সমাজের ভবিষ্যতকে দেশের স্বার্থে গড় তুলতে পারে।

লোকদেখানো যুব কার্যক্রমের মাধ্যমে জনমিতিক সুবিধাকে কাজে লাগানো যাবে না। মনে রাখতে হবে যুবরাই আমাদের শক্তি। তাই ভবিষ্যৎ দেশ গঠনে যুব সমাজকে উন্নয়নের শক্তিতে রূপান্তরিত করা আব্যশক।

লেখক : উপপরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সিলেট