মার্কিন নির্বাচনে গাধা, হাতি ও প্রতীকের লড়াই!
রাজনীতিতে দল, নেতা ও মতাদর্শের লড়াই শেষ পর্যন্ত নানা ধরনের প্রতীকের যুদ্ধে পর্যবসিত হয়। বাংলাদেশে যেমন ধানের শীষ, নৌকা, লাঙল ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের বাজার দখল করে গাধা ও হাতি। রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রতীকের প্রাধান্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। প্রতীক ছাড়াও বিভিন্ন রঙ ও ঢঙ্গ দেখে বিভিন্ন দল ও আদর্শকে চিহ্নিত করা যায়। যেমন লাল বাম বিপ্লবীদের, সবুজ ইসলামপন্থীদের আর গেরুয়া হিন্দুত্ববাদের প্রতিনিধিত্ব করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নির্বাচনী প্রতীক ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থানে এসেছে। বিশ্লেষক Willmoore Kendall এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে The Basic Symbols of the American Political Tradition নামে একটি বিরাট মাপের বই রচনা করেছেন। আরও অনেক লেখক মার্কিন রাজনীতি, নির্বাচন এবং প্রধান দুটি দলের পছন্দ ও প্রতীকায়ন নিয়ে লেখালেখি করেছেন, যেখানে মার্কিন রাজনীতি, নির্বাচন, গাধা, হাতি ও প্রতীকের লড়াই সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান দলের শতাব্দী প্রাচীন প্রতীকের উত্থান ১৮০০ সালের দিকে, যখন মিডিয়ায় রাজনৈতিক কার্টুন নিয়ে চর্চা ও বিশ্লেষণ হতো আমজনতার মধ্যে। কার্টুনের মাধ্যমে প্রেরিত বার্তায় কঠোর, জটিল ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক বিষয় বা ইস্যু অর্থবহ হতো সাধারণ মানুষের কাছে। একই সঙ্গে তাতে থাকতো হালকা কৌতুকের চমক।
জনপ্রিয় কার্টুনে মিডিয়া অল্প জায়গা বা স্পেস খরচ করে বড় বড় ম্যাসেস এবং গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়। তাতে একটি ধারণার জন্ম নেয় যে, গাধা হতে পারে কষ্টসহিষ্ণুতার প্রতীক। এবং হাস্যরস বা বোকার প্রতীক হিসেবেও দেখা চলে গাধাকে। অন্যদিকে, হাতি হতে পারে মহান কিছু। কিংবা হতে পারে বিদঘুটে কিছুর প্রতীক। হতে পারে স্থিতিশীলতার স্তম্ভ অথবা রাজা-বাদশাদের বাহনের প্রতীক। এই দুই জন্তু এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীক রূপে জায়গা করে নেয়।
এমনিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকান সমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রতীকের ছড়াছড়ি রয়েছে। নিউইয়র্ককে মানুষ স্বনামে না ডেকে বলে ‘বিগ অ্যাপেল‘। ‘সান্তা ক্লজ‘ বললে ধর্মীয় আমেজ চলে আসে। পুরো আমেরিকার প্রতিচিত্র উপস্থাপিত হয় ‘আঙ্কেল স্যাম‘ নামের প্রতিধ্বনিতে। মার্কিন পতাকার প্রতিবিম্ব প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রায়-সর্বক্ষেত্রে লাল, সাদা এবং নীল রঙের প্যাটার্ন ব্যবহার করার মাধ্যমে। টাই, কোট, জামা, প্যান্ট থেকে শুরু করে পণ্যের মার্কিন উপস্থিতি বুঝাতে আনা হয় লাল, সাদা এবং নীল রঙের ছোঁয়া। এমন কি, আমেরিকান পতাকার চেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা দিবসের সমার্থক কিছু প্রতীক রয়েছে। লাল, সাদা এবং নীল প্যাটার্নটি প্রায়শই বাড়ির সামনে উড়ে যায় এবং জুলাই মাসের চতুর্থ তারিখে বেসবল ক্যাপ থেকে ফ্লিপ-ফ্লপ পর্যন্ত সবকিছুতে শোভা পায়। তেমনিভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির কোনও বিষয় চলে এলেই সামনে এসে হাজির হয় তাদের দলীয় নির্বাচনী প্রতীক গাধা। আর রিপাবলিকান পার্টি‘র ক্ষেত্রে হাতি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট (১৮২৯-১৮৩৭)। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁকে ‘জ্যাকঅ্যাস’ অর্থাৎ গাধা বলে ডাকত। জ্যাকসন নামটি পছন্দ করেন এবং গাধাকে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন। ওই সময় একজন কার্টুনশিল্পী তাঁর মাথাটা একটি গাধার শরীরের ওপর বসিয়ে কার্টুন আঁকেন। অবশিষ্ট রাজনৈতিক জীবনে অ্যান্ড্রু জ্যাকসনকে এই গাধার ছায়া বহন করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর ডেমোক্র্যাট দলীয় অন্য নেতাদেরও প্রতীক হয়ে ওঠে গাধা। প্রায় একই সময়ে একজন কার্টুনশিল্পী হাতিকে রিপাবলিকানদের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেন। ওই সময় প্রশাসনের নানা কেলেঙ্কারিতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি ওই প্রতীকের কথা চিন্তা করেছিলেন। এরপর অন্যান্য কার্টুনশিল্পীও এই প্রতীক লুফে নেন। সেই থেকে নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের প্রতীক গাধা আর রিপাবলিকানদের প্রতীক হাতি।
প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো ২০২৪ সালের নির্বাচনেরও প্রার্থিীদের সমান্তরালে দেখা যাচ্ছে তাদের প্রতীকের বিস্তর ব্যবহার। বিশ্বরাজনীতিতে এবারের মার্কিন নির্বাচন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তা আরও বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার পটভূমিতে কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না যে, শেষ পর্যন্ত কে নির্বাচিত হয়ে ওয়াশিংটনের মসনদে বসবেন। তবে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি ফিরে আসেন কিংবা কমলা হ্যারিস যদি নির্বাচিত হন, তাহলে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, সমগ্র বিশ্বরাজনীতিতেই ব্যাপক পালাবদল দেখা যাবে। সূচিত হবে নতুন নীতি ও কৌশল এবং মেরুকরণ।
এমনই পটভূমিতে ৫ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা, যাতে প্রাধান্য পাচ্ছে গাধা এবং হাতির চিত্র-বিচিত্র রাজনৈতিক কার্টুন। প্রচারণার বোতাম, ইন্টারনেট মেম এবং কিছু সত্যিকারের উদ্বেগজনক ফ্যাশন পছন্দগুলোতেও ডেমোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টি‘র সিম্বল বা প্রতীক প্রদর্শিত হচ্ছে। এটা অন্যথায় হওয়ার কোনও সুযোগই নেই। কারণ, আমেরিকার রাজনীতি ও নির্বাচনে গাধা ও হাতি ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতির মূল ভিত্তি স্বরূপ। ঐতিহাসিক পর্যায় পেরিয়েই প্রতীক দুটি ম্যাভেরিক কার্টুনিস্টদের দ্বারা জনপ্রিয় হয়েছে এবং ক্রমে ক্রমে আধুনিক রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এতে রাজনীতিবিদদের ভূমিকার চেয়ে শিল্পী, কার্টুনিস্ট ও মিডিয়ার ভূমিকা অনেক বেশি, যা সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষ গ্রহণ করেছে।
রাজনৈতিক প্রতীকায়নের ইতিহাসে সবচেয়ে আগে নাম আসে থমাস নাস্ট-এর, যিনি ১৮৬২ থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত হার্পারস উইকলিতে কার্টুনিস্ট ছিলেন এবং যাকে গণ্য করা হয় আমেরিকার প্রথম মহান রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট রূপে। তাকে বলা হয় মার্কিন শিল্প ও সংস্কৃতির ইতিহাসে ‘কঠোরতম ব্যঙ্গশিল্পীদের অন্যতম একজন‘।
থমাস নাস্ট-এর আমলে প্রযুক্তি উন্নত ছিল না। আধুনিক প্রকাশনার বিকাশও তখন ঘটে নি। তাকে কাজ করতে হয়েছে কাঠের ব্লক খোদাই করে। জটিল ও শৈল্পিকভাবে কাঠের খোদাইয়ে জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। তিনি তার অঙ্কনের মাধ্যমে মার্কিন দেশের গৃহযুদ্ধ, পুনর্গঠন, অভিবাসন এবং রাজনৈতিক মেশিনের মোকাবিলা করেছিলেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের প্রাধান্যের কারণে তাকে ‘দুষ্টু শিল্পী‘র উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তার কার্টুনের দিকে এক নজর তাকালে বিশ্বাস করা যায় যে, তিনি কতটা তীব্রভাবে সমাজ ও রাজনীতিকে আঘাত করেছিলেন।
ইতিহাসবিদরা দাবি করেছেন যে, নাস্ট মার্কিন রাজনীতির দুই প্রধান দলের নির্বাচনী প্রতীককে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছেন। নাস্ট ১৮৪০ থেকে ৫০, এই দশ বছর নিউইয়র্ক সিটিতে বড় হয়েছিলেন। শৈশবে তাকে যে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল, তা তিনি বিস্মৃত হন নি। তিনি ছিলেন সবলের দ্বারা দুর্বলের প্রতি রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগের ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী। ফলে তার কেরিয়ারের মধ্য দিয়ে যে দুটি থিম চলে আসে, তা হলো সবল ও দুর্বল তথা বড় আর ছোট। তিনি সমস্ত নির্যাতনকে বড় ও ছোট আকারের দ্বারা উপহাসমূলক অবজ্ঞার মাধ্যমে চিত্রিত করেন। যেসব ছবিতে ঘৃণা ও প্রতিবাদের পাশাপাশি স্থান পেয়েছিল নির্যাতনের শিকার অসহায় মানুষদের প্রতি সমবেদনা।
হার্পারস প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করার সময় নাস্ট মার্কিন দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক মেরুর অবয়ব নির্মাণ করেছিলেন। দল দুটোকে উপস্থাপন করতে তিনি তাদের প্রতীককে সামনে রেখে কার্টুন রচনা করতেন। তার বক্তব্যকে রাজনৈতিক দলের প্রতীকের লেবেলযুক্ত কার্টুনে উপস্থাপন করায়, সেগুলো একেকটি স্বতন্ত্র সংবাদ-এ পরিণত হয়। তার চিত্রগুলো তুলে ধরতো স্পষ্ট বক্তব্য এবং সঠিক যুক্তি। তার কার্টুনে বিন্দু-বিন্দু বিশ্লেষণ এবং আলোচনা নিহিত থাকতো, যা পাঠকদের চিন্তা-ভাবনা করতে এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ ও বিরোধিতার পথে যেতে উদ্বেলিত করতো।
আমেরিকার রাজনীতিকে একটি চিত্রময় প্রতীতের মধ্য দিয়ে নির্মোহ অবয়বে উপস্থাপন করা নাস্টের অন্যতম কৃতিত্ব। তার ছিল বহুমাত্রিক অন্তর্দৃষ্টি। আর ছিল দূরদৃষ্টি। তার কার্টুন মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করতে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছিল। যা তাকে মার্কিন ইতিহাসের সেরা ব্যঙ্গাত্মকদের একজনে রূপান্তরিত করেছে। তার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি তার বিরোধীদের মতোই নিজের পক্ষকেও আনন্দের সাথে উপহাস করেছিলেন। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতায় তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাসী ছিলেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং বাক-ব্যক্তি-মত প্রকাশের স্বাধীনতায়। যেজন্য তিনি শাসক ও বিরোধী, উভয় পক্ষকেই প্রয়োজনে তীব্র সমালোচনা করেছেন। ব্যক্তি বা দলের বদলে গাধা ও হাতি নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গ এবং ক্যারিকেচার করায় সমালোচিত ব্যক্তি বা দলের সরাসরি মানহানির ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়েছিল এবং জনগণকেও গাধা ও হাতিকে অবলম্বন করে ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং রিপাবলিকান পার্টির সমালোচনা-বিরোধিতার পথে প্রণোদিত করা সহজ হয়েছিল।
নাস্ট কার্টুনে দেখিয়েছেন যে, গাধার মতো একগুঁয়ে জন্তুটির লেজের সাথে ঝুলছে, ‘আর্থিক বিশৃঙ্খলা‘, যা এক অতল গহ্বরে পড়তে চলেছে। আবার প্রায়শই তিনি হাতি নিয়ে এমন কার্টুন করেছেন, যা দলীয় নেতাদের নীতি ও ব্যক্তিত্বের মন্দ দিকগুলোর সমালোচনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মার্কিন গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার গঠনমূলক সমালোচনা ও ন্যায্য মূল্যায়ন করাই ছিল তার উদ্দেশ্য, যা অবশেষে মার্কিন গণতান্ত্রিক ধারা ও সংস্কৃতিকে সুদৃড়গাঁথুনি পেয়েছে। সমালোচনা যে গণতান্ত্রিক সমাজে বহুমতের বিকাশে জরুরি, তা মার্কিন রাজনীতির প্রতীকগুলো নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ঐতিহ্যগত দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রতিফলিত হয়।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।