মার্কিন রাষ্ট্রপতি পদে নারী নেতৃত্ব কি অধরাই থেকে যাবে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৮ বছরের ইতিহাসে কখনও কোনো নারী প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তবে কয়েকজন নারী প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হয়েছেন। ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তবে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হন। এবছর ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে হেরে গেলেন। ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের ৫৩৮টি আসনের মধ্যে কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২২৩ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঝুলিতে পড়েছে ২৭৯ ভোট। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এবার দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হবার সৌভাগ্য ফিরে এলো।
সেদেশের রেওয়াজ অনুযায়ী আগামী জানুয়ারী মাসে তিনি ৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিবেন। তাঁকে আগাম অভিনন্দন।
এই ভোটের আগে বিভিন্ন জরিপের ফলাফলে কমলা হ্যারিস এগিয়ে ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস দায়িত্ব পালন করছেন, যিনি প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম এশীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অনেক এগিয়ে ছিলেন। কমলার ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়া এবং সিনেট ও কংগ্রেসে অনেক নারীর নির্বাচিত হওয়া থেকে বোঝা গিয়েছিল, মার্কিন জনগণ নারীদের নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহী। কিন্তু তাঁর সেসব অভিজ্ঞতা ও জরিপের ফলাফলকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়রথ বেজে উঠেছে।
নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণের সময় এখনও আসেনি। তবে কিছু কিছু বিষয় এখনই বলা যেতে পারে। হ্যারিস একজন নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট। ওদেশে কিছু ভোটার এখনও ঐতিহ্যগতভাবে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের নেতৃত্বে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এই সাংস্কৃতিক পক্ষপাত তার প্রচারণাকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। কমলা হ্যারিসের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অনেকের কাছে যথেষ্ট মনে হলেও, তিনি তুলনামূলকভাবে নতুন। অনেক ভোটার তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্বদানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আগেই নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন।
এছাড়া তার কিছু নীতিগত অবস্থান ও বক্তব্য ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, অভিবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, এবং অপরাধ বিষয়ক তার অবস্থান নিয়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরেই ভিন্নমত রয়েছে। এই নীতিগত অবস্থান ভোটারদের একাংশের কাছে কিছুটা বিতর্কিত করে তুলেছিল। মার্কিন রাজনীতি বর্তমানে গভীরভাবে বিভক্ত এবং অনেক রিপাবলিকান বা মধ্যপন্থী ভোটার ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসেবে তাকে সমর্থন নাও করে থাকতে পারেন।
পাশাপাশি, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অভ্যন্তরেও একাধিক মতাদর্শগত বিভাজন রয়েছে, যা তার সমর্থনে একটি বাধা হয়ে থাকতে পারে। হ্যারিসকে নিয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচক প্রচারণা হয়েছে। তার ব্যক্তিত্ব, বক্তব্য এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক সময় অতিরঞ্জিত সমালোচনা হয়েছে, যা তার ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষত: গ্রামাঞ্চলে তার পরিচিতি সীমিত ছিল বলে অনেকে মনে করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন নারীর নির্বাচিত হওয়ার পথে কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসে এবং প্রার্থীদের প্রচারণা ও ভোটারদের মনোভাবের ওপর প্রভাব ফেলে। কমলার ক্ষেত্রে সেগুলো প্রভাব বিস্তার করে থাকতে পারে। কিছু মানুষ এখনো মনে করেন যে নারীরা পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবন সামলাতে গিয়ে প্রেসিডেন্টের মতো চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব সামলাতে সক্ষম হবেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট পদে দীর্ঘদিন ধরে পুরুষ প্রার্থীদের আধিপত্যের ফলে নারীদের রাজনৈতিক যোগ্যতা নিয়ে কিছুটা সন্দেহ করা হয়েছিল। অনেক ভোটার নারী প্রার্থীর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিশেষ করে আফ্রিকা ও উপমহাদেশের অভিবাসী কিছু ভোটার। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে এখনও ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক রীতির কারণে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে পক্ষপাত দেখা যায়। এসব অঞ্চলের ভোটাররা নারী নেতৃত্বের প্রতি অনাগ্রহী হতে পারেন, যা নির্বাচনে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। ফলে সেসব অঞ্চলে জরিপের ফলাফলের উল্টোচিত্র দেখা গেছে। বিশেষ করে সুইং ভোটের রাজ্যগুলোতে কমলার পিছিয়ে থাকার জন্য এটা অনেকাংশে দায়ী বলে মনে হচ্ছে।
এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কখনোই একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি, তাই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়া একটি বড় পরিবর্তন হিসেবে দেখা হবে। অনেক ভোটার এই পরিবর্তনকে ঐতিহ্যের পরিপন্থী মনে করতে পারেন এবং এই নতুনত্বকে গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীরা মার্কিন রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছেন এবং ক্রমাগত এই বাধাগুলো দূর করছেন। ফলে ভবিষ্যতে নারী প্রার্থীদের জন্য এ ধরনের বাধা কমে আসবে বলে আশা করা যায়, এবং একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। অপরদিকে ট্রাম্প অভিবাসী ঠেকানোর কথা বলেও কীভাবে অভিবাসীদের মন জয় করলেন তা এই মুহূর্তে বড় ভাবনার বিষয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অভিবাসন সংক্রান্ত কঠোর নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েই অনেক সমর্থন পেয়েছিলেন, যা তার বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ এবং অবৈধ অভিবাসী প্রবেশ ঠেকানোর কথা বলেছিলেন। এই প্রতিশ্রুতিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাংশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, এবং চাকরি রক্ষার উদ্বেগকে প্রভাবিত করেছিল। ফলে এবছর ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান তার অনেক সমর্থকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাঁকে নির্বাচনে জিততে সাহায্য করেছে বলে মনে হচ্ছে।
যদিও তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ এবং কঠোর অভিবাসন নীতি বাস্তবায়নে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তবে এসব উদ্যোগ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক এবং আইনি বাধাও ছিল। তবুও তার এই কৌশল নির্বাচনী প্রচারণায় তাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছিল এবং ঐ নির্বাচনে তার বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল, এবারও ফেলে থাকতে পারে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের নির্বাচনে মতো ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি নতুন যুদ্ধ শুরু করবেন না এবং চলমান যুদ্ধগুলো বন্ধ করতে চেষ্টা করবেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি কিছু ক্ষেত্রে এই প্রতিশ্রুতি আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যেমন আফগানিস্তান ও সিরিয়া থেকে সৈন্য কমানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করার পদক্ষেপ। এছাড়া ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকালে ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে উত্তেজনা বেড়েছিল, যদিও তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হয়নি।
মার্কিন ভোটারদের মধ্যে অনেকেই নারী নেতৃত্বকে সমর্থন করেন, তবে প্রেসিডেন্ট পদে একজন নারীকে নির্বাচিত করতে এখনও কিছু মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক বাধা রয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীদের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট পদে কেবল পুরুষদের নির্বাচিত করার দীর্ঘ অভ্যাস রয়েছে। এই ঐতিহ্য থেকে সরে আসা অনেক ভোটারের জন্য একটি বড় পরিবর্তন এবং কিছু ভোটার মনে করেন যে ঐতিহ্যগতভাবে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে পুরুষরাই উপযুক্ত।
এছাড়া প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সময় মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি, অবৈধ অভিবাসী বৃদ্ধি ও ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ব্যয়ভার বৃদ্ধিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচারের সময় নেতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে ভোটারদেরকে মটিভেটেড করেছেন। কমলা হ্যারিস প্রতিটি জনসভায় হাসি দিয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন-যে কথা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও তাঁর এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন।
কিন্তু আজকাল যে কোন দেশেই ভোটাররা শুধু মুখের হাসিতে ভুলতে চান না। তারা সবার জন্য একটি টেকসই আর্থ-সামাজিক-মানবিক কল্যাণের নিশ্চয়তা চান। কিছু মার্কিনির মধ্যে এমন একটি পক্ষ রয়েছে যারা মনে করেন নারীরা অনেক আবেগপ্রবণ এবং যুদ্ধ বা সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় অপারগ হতে পারেন। যদিও এই ধারণা অনেকাংশেই ভুল। তবুও এটি মার্কিন নারীদের প্রেসিডেন্ট পদে উন্নীত হওয়ার পথে বারবার বাধা হয়ে আসতে পারে। এই দৃষ্টিতে সামনে তাই আরো বহুবছর মার্কিন রাষ্ট্রপতি পদে নারী নেতৃত্ব অধরাই থেকে যেতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]