দরপত্র জমা না দেওয়ার কারণ মেইল করেছে আইওসি!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র, ছবি: সংগৃহীত

গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র, ছবি: সংগৃহীত

গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র কিনলেও জমা না দেওয়ার একাধিক কারণ জানিয়েছে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো (আইওসি)। দরপত্র ক্রয় করা ৭ বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে একাধিক কোম্পানি মেইল করে তাদের মতামত জানিয়েছে বলে পেট্রোবাংলা সূত্র নিশ্চিত করেছে।

গভীর সমুদ্র থেকে স্থলভাগ পর্যন্ত পাইপলাইনের হুইলিং চার্জ, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ), ডাটার দাম বেশি ধরা, পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়টি সামনে এসেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ডব্লিউপিপিএফের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশাল বিনিয়োগ তার মুনাফাও বিশাল হওয়ার কথা, ওই ফান্ড নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কেউ কেউ আপত্তি তুলেছে। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের সঙ্গে তার কর্মীদের বিবাদ বিদ্যমান।

বিজ্ঞাপন

বিশাল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পূর্বেই ৭টি বহুজাতিক কোম্পানি দরপত্র কিনলেও শেষ পর্যন্ত জমা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। কেন বিরত থাকল সেই কারণ উদঘাটনে কমিটি গঠন করেছে পেট্রোবাংলা। ওই কমিটি দরপত্র ক্রয় করা ৭ বহুজাতিক কোম্পানিকে মেইল করে মতামতের জন্য। তারা কেউ কেউ মৌখিকভাবে, আবার দু’টি কোম্পানি ইতোমধ্যে মেইল করে মতামত পাঠিয়েছে বলে পেট্রোবাংলা সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে ২৪টি ব্লকে (গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯ টি) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হয় চলতি বছরের ১১ মার্চ। দরপত্র জমার জন্য ৬ মাস (৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সময় দেওয়া হয়। সময় শেষ হওয়ার আগেই ৩ মাস বাড়িয়ে ৯ ডিসেম্বর করা হয়। মার্কিন কোম্পানি এক্সোন মবিলসহ ৭টি আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা কোম্পানি দরপত্র কিনেছিল, ২টি কোম্পানি পেট্রোবাংলা থেকে ডাটা কিনেছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউই দরপত্র জমা দেয় নি। যে কারণে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে দরপত্র।

বিজ্ঞাপন

কারণ জানতে পরিচালককে (পিএসসি) প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়। পরিচালক পিএসসি আলতাফ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা প্রত্যেকটি কোম্পানিকে মেইল করে তাদের মন্তব্য জানতে চেয়েছি। একাধিক কোম্পানির মেইল পেয়েছি, তাদের কাছে আরও বিস্তারিত জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে।

যারা মেইল করেছে তারা কি বিষয় তুলে ধরেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিষয়টি এখনই মন্তব্য করার মতো পর্যায়ে আসেনি।

সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি আপডেট করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্য আকর্ষণীয় করা হয় পিএসসি (উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি)। আগের পিএসসিতে গ্যাসের দর স্থির করে দেওয়া হলেও এবার ব্রেন্ট ক্রুডের দরের সঙ্গে মিল করে দেওয়া হয়। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান। যা আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল।

দামের পাশাপাশি বাংলাদেশের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মডেল পিএসসি-২০১৯ অনুযায়ী গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের অনুপাত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আর কমতে থাকে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার। গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের হিস্যা ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করবে। কিন্তু তারপরও কোন আগ্রহী প্রতিষ্ঠান না পাওয়াটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মডেল পিএসসি ২০০৮ প্রণয়ন কমিটির প্রধান মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, অনেকে মনে করেছিলেন গ্যাসের দাম বাড়ালেই কোম্পানিগুলো দৌড়ে আসবে। সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেন জমা হয়নি সেটা তালাশ করার পাশাপাশি কেন মাত্র ৭টি কোম্পানি দরপত্র কিনেছে সেটাও দেখা দরকার। পিএসসিতে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে, এখানে শর্ত দেওয়া হয়েছে দৈনিক ২০ হাজার ব্যারেল (তেলের সমান) গ্যাস উত্তোলন করে এমন কোম্পানি দরপত্র কিনতে পারবে। এখানেইতো অনেক কোম্পানি বাদ পড়ে গেছে। আমি মনে করি গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ১০ হাজার এবং অগভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ৫ হাজার ব্যারেল হওয়া উচিত। তাহলে আরও অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিতে পারবে।

তিনি বলেন, আমরা যখন ২০০৮ সালে পিএসসি প্রণয়ন করি তখন ১৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দিতে যাচ্ছিলাম। একটি বিদেশি কোম্পানি এসে আমাদের বললো ২৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দেওয়ার জন্য। আমরা রাজি না হলেও মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ হাজার করা হয়েছিল। আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ডাটা প্যাকেজের দাম অনেক বেশি। কোন কোন প্যাকেজের দাম মিলিয়ন ডলারের মতো। অন্য দেশে এসব ডাটা ফ্রি দেয়। ১৯৭৪ সালে আমাদের দেশে এসব ডাটা উন্মুক্ত ছিলো, তখন অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিয়েছিলো।

রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে, বড় কোম্পানিরা সার্বিক বিষয়ে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করার আগে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমরা আসলে ডাটার ব্যবসা করবো, নাকি গ্যাস দরকার। সেটা আগে চিহ্নিত করা দরকার। ডাটার দাম এতো রাখার কোন যৌক্তিকতা দেখি না।

পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, দেশে ৮টি গ্রাহক শ্রেণিতে দৈনিক অনুমোদিত লোড রয়েছে ৫ হাজার ৩৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট, (দৈনিক) এর বিপরীতে চাহিদা ধারণা করা হয় ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, আর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিলিয়নের মতো।

তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড়ে ২ হাজার ৪৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের তথ্য পাওয়া গেছে বিইআরসিকে দাখিলকৃত তথ্যে। বেশি চিন্তার হচ্ছে প্রতিনিয়ত দেশীয় গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ন্ত রয়েছে চাহিদা। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন উৎপাদন হলেও এখন ১৯৩০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। এর অন্যতম কারণ বিবেচনা করা হয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে স্থবিরতাকে। অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতে মনযোগ বেশি ছিল বিগত সরকারগুলোর।