টানা দুই যুগ ধরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাশার আল-আসাদ। কিন্তু বিদ্রোহী যোদ্ধাদের ঝোড়ো অভিযানের মাত্র ১২ দিনের মাথায় বাশার আল-আসাদের ইস্পাত-কঠিন শাসনের অবসান ঘটেছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে বাশার আল-আসাদের পতনের পরও সিরিয়ায় একের পর এক হামলা কেন চালাচ্ছে ইসরায়েল।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের পতনের পর পরই সিরিয়ার সামরিক বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে থাকে ইসরায়েলি সেনারা। গত ৪৮ ঘণ্টায় সিরিয়ার ভূখণ্ডে ৪৮০টি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, সিরিয়ার ১৫টি নৌযান, বিমান–বিধ্বংসী ব্যাটারি, অস্ত্র উৎপাদন ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামোয় এসব হামলা চালানো হয়েছে।
এর আগে লন্ডনভিত্তিক পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) জানায়, গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের হাতে বাশার আল–আসাদের সরকার পতনের পর থেকে সিরিয়াজুড়ে ৩১০টির বেশি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর লক্ষ্য হলো তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেকোনো কৌশলগত হুমকির সক্ষমতা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া—এক বিবৃতিতে এমনটাই জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ।
তবে ইসরায়েলের এমন কাণ্ডে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে। কারও কারও মতে, ইসরায়েল আবার গোলান মালভূমিতে ‘দখল’ পাওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও ইসরায়েলের দাবি, তারা নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্যই হামলা চালাচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে নেতানিয়াহুর প্রশাসন। তাদের বক্তব্য, এই হামলা ‘সীমিত এবং সাময়িক’।
গত ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার বিদ্রোহীরা রাজধানী শহর দামেস্কের দখল নেয়। ওই তপ্ত পরিস্থিতির মাঝে সিরিয়া ছাড়েন বাশার। একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, তিনি রাশিয়ায় সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন। বাশারের দামেস্ক ত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিরিয়ার ওপর হামলা শুরু করে ইসরায়েল। বেশির ভাগ হামলা হয়েছে সিরিয়ার সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে। তালিকায় রয়েছে একটি গবেষণা কেন্দ্রও। সেখানে সিরিয়া বিভিন্ন রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে বলে সন্দেহ করা হয়। যদিও তার কোনও প্রমাণ মেলেনি।
যদিও ইসরায়েলের দাবি, ওই অস্ত্র যাতে সিরিয়ার চরমপন্থীদের হাতে না পৌঁছে যায়, সেই কারণে হামলা চালিয়েছে তারা।
বাশারের পতনের পর সিরিয়াকে সামরিকভাবে কার্যত ‘পঙ্গু’ করে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে ইসরায়েল। বাছাই করে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং অস্ত্রভান্ডারগুলোতে হামলা সে দিকেই ইঙ্গিত করছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটায় জানিয়েছেন, যেসব অঞ্চল ইসরায়েলের ক্ষতি করতে পারে, শুধু সেই অঞ্চলগুলোতেই হামলা চালানো হচ্ছে। সিরিয়ার নৌবহর ধ্বংস করাকেও একটি ‘বড়’ সাফল্য হিসেবে মনে করছেন তিনি।
ইসরায়েলের দাবি, তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এই হামলাগুলো চালাচ্ছে। তবে এর নেপথ্যে গোলান মালভূমির ওপর ‘কব্জা’ পাওয়ার চেষ্টাও থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর সিরিয়ার গোলান মালভূমি ইসরায়েলের দখলে চলে গিয়েছিল। পরে তা ফিরিয়ে দিলেও, একটি অংশ নিজেদের দখলে রেখে দেয় ইসরায়েল। যদিও আমেরিকা ছাড়া দুনিয়ার অধিকাংশ দেশই আংশিক দখলে থাকা গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অংশ বলে মানেনি। এরই মধ্যে দু’দিন আগে নেতানিয়াহু গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের অংশ বলে দাবি করেছেন।
বাশারের পতন হতেই ইসরায়েলের সিরিয়ার ওপর হামলা শুরু করায় তাই নেতানিয়াহু প্রশাসনের অভিপ্রায় নিয়ে সংশয় জেগেছে অনেকের মনে।
বিদ্রোহী যোদ্ধাদের মাত্র ১২ দিনের অভিযানে গত রোববার বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটে। বাবা হাফিজ আল-আসাদ ও ছেলে বাশার আল-আসাদ মিলে টানা ৫৩ বছর সিরিয়া শাসন করেছেন। এর মধ্য সর্বশেষ ২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন বাশার আল–আসাদ।
সিরিয়া থেকে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে পালিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন বাশার আল-আসাদ। তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে রাশিয়া। পরিবারের সদস্যসহ তিনি এখন মস্কোয় অবস্থান করছেন।