সুফিবাদ ও রহস্যময়তার পীঠস্থান আজমীর শরীফ
ইতিহাস, ঐতিহ্য, সুফিবাদ এবং রহস্যময়তার পীঠস্থান হলো ভারতের রাজস্থানের খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর দরগাহ। ধর্ম, সম্প্রদায় ও ভৌগলিক সীমানার চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে এটি এমন এক স্থান অর্জন করেছে, যা পরিদর্শন করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে যায়।
শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন, হিন্দুরা দর্শনার্থীও আজমীরের দরগাহে উপস্থিত হয়। সেখানে নারীরাও প্রবেশ করতে পারে। বহু হিন্দু নারীই এই দরগাহে যায় মানত পূরণ করতে।
বর্তমান সময়ে খবরের শিরোনাম আজমীরের দরগাহ, তবে সেটা ভিন্ন কারণে। শিব মন্দিরের ওপরে এই দরগাহ বানানো হয়েছিল বলে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন হিন্দু সেনা নামে এক সংগঠনের সভাপতি ভিষ্ণু গুপ্তা।
তার দাবির স্বপক্ষে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক হরবিলাস সারদারের বইয়ের তথ্যসহ তিনটি কারণ উল্লেখ করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি এবং সেখানে হিন্দুদের পূজা করার অনুমতির জন্যও আবেদন জানিয়েছেন। ভিষ্ণু গুপ্তার দাবি, মন্দিরের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে।
অন্যদিকে, আজমীর দরগাহের প্রধান উত্তরাধিকারী এবং খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর বংশধর সৈয়দ নাসিরুদ্দিন চিশতী ওই দাবিকে ‘সস্তা প্রচার পাওয়ার জন্য স্টান্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
আগামী ২০ ডিসেম্বর আজমীরের খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর দরগাহ-সংক্রান্ত মামলার শুনানি রয়েছে। অন্যদিকে, জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর উরস। উরস উপলক্ষে প্রতিবছর দুই সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানে শামিল হন কয়েক লাখ মানুষ। বেশ আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই দরগাহকে ঘিরে যে দাবি ও পাল্টা দাবির ঝড় উঠেছে তাকে কেন্দ্র করে আজমীরের পরিস্থিতি অন্যবারের তুলনায় বেশ আলাদা।
আজমিরের খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর দরগাহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত দরগাহগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে মানুষ এই দরগাহ পরিদর্শনে আসে। দেশ-বিদেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং রাজনীতিবিদরা এখানে চাদর দেন।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ রাজস্থানের এই দরগাহ যার নামে তৈরি, তিনি হলেন রহস্যবাদী দার্শনিক ও সুফি সাধক খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘গরিবে নেওয়াজ’ নামে পরিচিত।
বলা হয়, মোহময়ী সাধক ছিলেন মুঈনুদ্দীন চিশতী। উন্নত ও অতুলনীয় জীবনাদর্শ বিখ্যাত করে তুলেছিল তাকে। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী মনে করতেন, মানুষ শান্ত থেকেও কারও অত্যাচারকে প্রতিহত করতে পারে। কথিত আছে, বহুদিনই তিনি নিজে একটা রুটি খেতেন কিন্তু ক্ষুধার্তদের জন্য সবসময় লঙ্গর প্রস্তুত থাকত। অসহায় এবং ক্ষুধার্ত দরিদ্রদের প্রতি তার আতিথেয়তার কথা কারোরই অজানা ছিল না।
ঐতিহাসিক রানা সাফভি লিখেছেন, ‘খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর বক্তৃতা রাজা ও কৃষক উভয়কেই আকৃষ্ট করেছিল। আজমিরের নাম শুনলেই খাজা গরিব নেওয়াজ ও তার দরগাহের ছবি মনে ভেসে ওঠে। এই সাধক সমুদ্রের মতো উদার এবং তার অতিথিপরায়ণতা ছিল বিশ্বের মতো ব্যাপক।’
খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর মৃত্যুর পর তার সমাধিতে এই দরগাহের নির্মিত হয় যা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লির সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। মান্ডুর সুলতান মাহমুদ খিলজি ও তার পরে গিয়াসউদ্দিন সেখানে সমাধিসৌধ এবং সুন্দর একটা গম্বুজ নির্মাণ করেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সম্ভবত প্রথম সম্রাট ছিলেন, যিনি ১৩২৫ সালে এই দরগাহ পরিদর্শন করেন।
আর তুঘলক শাসক জাফর খান দরগাহ পরিদর্শন করেছিলেন ১৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। সফরকালে সময় দরগাহের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বহু উপহার দিয়েছিলেন তিনি।
মান্ডুর খিলজি ১৪৫৫ সালে আজমিরের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন। ওই সময় এই দরগাহ তার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তার শাসনকালে দরগাহের প্রাঙ্গণে বিশাল ফটক, বুলন্দ দরওয়াজা এবং মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর আগে পর্যন্ত তেমন মজবুত কোনো নির্মাণ ছিল না সেখানে।
ঐতিহাসিকদের মতে, আদি দরগাহ ছিল কাঠের তৈরি। পরে এর ওপর একটা পাথরের ছাউনি নির্মাণ করা হয়।
ইতিহাসবিদ রানা সাফাভির মতে, ‘দরগাহ পরিসরে নির্মাণের প্রথম মজবুত প্রমাণ হলো- তার গম্বুজ, যা ১৫৩২ সালে অলঙ্কৃত করা হয়েছিল। এটা সমাধির উত্তর দেয়ালে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটা শিলালিপি থেকে স্পষ্ট। এই সেই সুন্দর গম্বুজ যা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গম্বুজকে পদ্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে এবং রামপুরের নবাব হায়দার আলী খানের দেওয়া একটা সোনার মুকুট এর ওপরে স্থাপন করা হয়েছে।’
ঐতিহাসিক আবুল ফজল লিখেছেন, ‘আকবর প্রথম মোগল শাসক যিনি ১৫৬২ সালে প্রথমবার দরগাহ পরিদর্শন করেছিলেন। দরগাহের সঙ্গে যুক্ত লোকদের উপহার ও অনুদান দিয়েছিলেন।
তার মতে, ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে আকবর তার প্রথমবারের মানত পূরণের জন্য পায়ে হেঁটে দরগাহে এসেছিলেন। তখন আকবর দেখেছিলেন যে, হাজার হাজার দরিদ্র ও তীর্থযাত্রীদের জন্য লঙ্গরের আয়োজন করা হয়েছিল। তাই তিনি আজমীর, চিতোর এবং রণথম্ভোরের ১৮টা গ্রাম দিয়ে দেন।
আকবর ১৫৬৯ সালে আজমিরে একটা মসজিদ ও খানকা নির্মাণের নির্দেশ দেন। সেই আদেশ অনুযায়ী তৈরি হয় লাল বেলেপাথরের আকবরী মসজিদ। শাহজাহান ১৬৩৭ সালে একটা সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন যা দরগাহের পশ্চিমে শাহজাহানী দরওয়াজার সঙ্গে অবস্থিত।
আজমিরের এই দরগাহ পরিদর্শনে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আসে এবং এই পরম্পরা শত শত বছর ধরেই চলে আসছে। বার্ষিক উরস উৎসবের সময় লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয় এবং এই রীতি এখনো চলে আসছে। এখানে নারীদের অবাধ প্রবেশ রয়েছে। হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নারীরাও এই দরগাহ দর্শনের জন্য আসে, কেউ বা নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য মানত করে।
প্রায় ৮০০ বছরের ইতিহাসে দিল্লির সুলতান, মোগল সম্রাট, রাজপুত, মারাঠা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী থেকেছে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর দরগাহ। তবে এর আগে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে কেউ আদালতের দ্বারস্থ হননি যেমনটা এখন হয়েছে।
তবে আজমীর শরীফের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা আঞ্জুমান কমিটি বিষ্ণু গুপ্তার দাবি খারিজ করে দিয়েছে। আঞ্জুমান কমিটির সেক্রেটারি সৈয়দ সরওয়ার চিশতী বলেন, ‘আমরা বংশানুক্রমিক খাদেম, যারা গত ৮০০ বছর ধরে দরগাহের সঙ্গে সম্পর্কিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য কাজ করছি। কিন্তু এক্ষেত্রে (মামলায়) আমাদের কোনো পক্ষই করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আঞ্জুমান কমিটি খাদেমদের প্রতিনিধিত্ব করে, আর দরগাহ কমিটি শুধু তদারকির কাজ করে। এটা ষড়যন্ত্র, যা আমরা হতে দেবো না। আমরা আমাদের আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করছি। আমরা আদালতে যাব।