ঈমান আনার পর স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সুযোগ নেই
ঈমান অর্থ বোধ, বিশ্বাস, স্বীকৃতি দেওয়া, আস্থা স্থাপন করা। আর আমল অর্থ কাজ। এই বিশ্বাস ও কাজের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রত্যেক মানুষের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মন, তার বোধ ও বিশ্বাস, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা।
মানুষ যে কাজই করুক না কেন, সে কাজ করার আগে তার মনে কাজটির প্রতি একটি ইচ্ছা তৈরি হয়। ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন, সে কাজটি করার পক্ষে একটি যুক্তি খুঁজে পায়- যা কাজটি সম্পাদন করাকে সে যুক্তিযুক্ত মনে করে। এভাবে সচেতনভাবে হোক কিংবা অবচেতন মনে মানুষের বোধ ও বিশ্বাস তার কাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। সুতরাং বলা যায়, মানুষের কাজ মূলত তার বিশ্বাসের প্রতিফলন।
ঈমান ও আমলের ব্যাপারটিও এ রকম। একজন প্রকৃত মুমিনের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে তার ঈমান। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মুমিন (বিশ্বাসী) ও কাফের (অবিশ্বাসী) ব্যক্তির ধারণা, বিশ্বাস ও জীবনবোধ যেমন এক নয়, তেমনি তাদের কাজও একরকম হতে পারে না। যারা পরকাল, আখেরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা, জান্নাত-জাহান্নাম বিশ্বাস করেন তাদের জীবনধারা কখনও তাদের মত হবে না যারা এসবে বিশ্বাস করেন না, যারা মনে করেন দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন, মৃত্যুর পর আর কোনো কিছু নেই, পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা বলে কিছু নেই। এ বিষয়টি স্বয়ং আল্লাহতায়ালা একাধিকবার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ‘জাহান্নামগামী লোকেরা ও জান্নাতগামী লোকেরা একরকম নয়। জান্নাতগামী লোকেরাই সফলকাম।’ -সুরা আল হাশর: ২৫
মদিনায় আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিরা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি তাদেরকে বলেন, তোমরা কি এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অর্থ জানো? তারা বললো, আল্লাহ এবং তার রাসূলই ভালো জানেন। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, (এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে) আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, আর মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল-এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া, নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা এবং রমজানে রোজা রাখা।’ -মিশকাত
সুতরাং শুধু মুখে মুখে ঈমানের দাবি করাই যথেষ্ট নয়, বরং আন্তরিক বিশ্বাস ও আমল তথা কথা ও কাজের মিল থাকা জরুরি।
অনেকে বলেন, ভাই নামাজ না পড়লে কী হবে, আমার ঈমান ঠিক আছে; তাদের জানা উচিত আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের যত জায়গায় ঈমানের কথা বলেছেন তার প্রায় সব জায়গাতেই তিনি আমলের কথাও বলেছেন। এ থেকেই বুঝা যায় ঈমানের সঙ্গে আমলের সম্পর্ক কত গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর ক্ষমা, মার্জনা ও দয়ার প্রশস্ততার ওপর নির্ভর করে নাজাত পাবে বলে নিজে নিজেই ধারণা করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে আর প্রবৃত্তির দাসত্ব এবং কামনার পেছনে ছুটছে। কোরআন মাজিদে তাদের কাজকে বোকামি ও দুর্বলতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের মাঝে এমন কিছু মূর্খ লোক আছে, যাদের মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া কিতাবের কোনো জ্ঞানই নেই। তারা কেবল অলীক ধারণা পোষণ করে থাকে।’ -সুরা আল বাকারা : ৭৮
বস্তুত, মানুষ যখন আল্লাহর কালামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায় তখন মনগড়া ধারণা কল্পনাকেই তার পথ প্রদর্শক বানিয় নেয়। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে, সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি নিজেকে কুপ্রবৃত্তির গোলাম বানায় অথচ আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা করে, সেই নির্বোধ ও ব্যর্থ।’ -জামে তিরমিজি
হজরত আমর বিন আবাসা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঈমান কি? জবাবে তিনি বললেন, সবর (ধৈর্য ও সহনশীলতা) এবং ছামাহাত (দানশীলতা, নমনীয়তা ও উদারতা) হচ্ছে- ঈমান। -সহিহ মুসলিম
সুতরাং ঈমানের ঘোষণা দেয়ার পর আল্লাহতায়ালার অবাধ্য হওয়া বা স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সুযোগ নেই। বরং পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর ইচ্ছার নিকট নিজেকে সোপর্দ করে ইসলামে দাখিল হওয়াই হচ্ছে- ঈমানের দাবি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা পূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু।’ -সুরা আল বাকারা : ২০৮
নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য কারো প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। আল্লাহর জন্যেই কাউকে দান করে এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকে; সে ব্যক্তি তার ঈমানকে পরিপূর্ণ করে নিলো।’ -সহিহ বোখারি