বছরে ৩ কোটি মানুষকে হজ-উমরার সুযোগ দিতে চায় সৌদি
হজ ও উমরা সৌদি আরবের ছোট ছোট ব্যবসার জন্য আয়ের অন্যতম উৎস। এসব ব্যবসার মধ্যে রয়েছে থাকার ব্যবস্থা, খাবার, পরিবহন এবং উপহার সামগ্রী বিক্রি। এ ছাড়া পরিবার নিয়ে সৌদি আরবে ভ্রমণের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। দেশটির দর্শনীয় স্থানগুলো পর্যটনবান্ধব করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, ব্যবস্থা করা হচ্ছে পরিবহনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার।
সৌদি আরবের মক্কা-মদিনায় হোটেল রুম সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হোটেল রুম থাকবে মক্কায়। দেশটির লক্ষ্য, ২০৩০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষের জন্য হজ ও উমরা পালনের জন্য সুযোগ তৈরি করা।
এ লক্ষে বেশ কয়েক বছর আগে ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা করেছে সৌদি আরব। এর অধীনে নিজেদের অর্থনীতিকে বহুমুখী করতে চাচ্ছে দেশটি। তারই অংশ হিসেবে সৌদি কর্তৃপক্ষ গত কয়েক বছর ধরে পর্যটনশিল্পের ওপর আলোকপাত করেছে এবং সফলও হয়েছে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে উমরাকে নানাভাবে যুক্ত করা হচ্ছে।
২০২৪ সালে ১৮ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ হজপালন করেছেন। আর ২০২৩ সালে ১৩ কোটি ৫৫ লাখের বেশি মানুষ উমরাপালন করেছেন। ২০২৪ সালের উমরাপালনকারীর সংখ্যা আরও বাড়বে। হজ ও উমরাপালনকারীর মধ্যে সৌদি আরবের বাইরে থেকে আসেন সিংহভাগ মানুষ।
হজ ও উমরাযাত্রী বৃদ্ধির কারণে মক্কা-মদিনায় যে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে, তা প্রতিবছরই বাড়ছে। হজ ও উমরাকেন্দ্রিক আর্থিক লেনদেন থেকে সৌদি আরব মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করছে।
আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, সৌদি আরব প্রতি বছর হজ ও উমরা খাত থেকে আনুমানিক ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত আয় আরও অনেক বেশি।
আবার হজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৌদি আরবের মোট দেশজ উপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ জোগান দেয়। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে চারটি শহর মক্কা, মদিনা, জেদ্দা ও তায়েফের অর্থনীতি পরিচালিত হয় হজ ও উমরার ওপর।
গালফ নিউজের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, হজকেন্দ্রিক আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ অন্তত পাঁচ হাজার কোটি ডলার। বিজনেস মনিটর ইন্টারন্যাশনালের সমীক্ষা অনুসারে হজের সময় উপহারসামগ্রী ও স্মারক বেচাকেনার পরিমাণ অন্তত ১৭০ কোটি ডলার। এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে টুপি, তসবিহ, জায়নামাজ, স্কার্ফ, বোরকা, হিজাব ইত্যাদি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রগ্রেসিভ পলিসি ইনস্টিটিউটের ‘ট্রেড ফ্যাক্ট অব দ্য উইক’ প্রকাশনায় ২০১৯ সালে বলা হয়েছিল, হজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক অনুষ্ঠান। এতে বলা হয়, চাইলে আরও লাখ লাখ মানুষ এসে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে হাজিদের সংখ্যা সীমিত রাখা হয়।
অন্যদিকে গার্ডিয়ান পত্রিকা হজকে অভিহিত করেছে মন্দারোধক (রেসেশন প্রুফ) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে। হজের মৌসুমে শুধু জেদ্দায় বাদশাহ আবদুল আজিজ বিমানবন্দরে যে পরিমাণ ফ্লাইট ওঠা-নামা করে, তা অন্যকোনো বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে হয় না। এই বিমানবন্দরের পরিসরও ব্যাপকভাবে বাড়ানো হচ্ছে যেন ২০৩৫ সাল নাগাদ এখানে বছরে আট কোটি যাত্রী ওঠা-নামা করতে পারে। অবশ্য এর মধ্যে অর্ধেকই হজ ও সারাবছরে উমরার জন্য আসা ব্যক্তি হবেন।
মক্কা-মদিনায় হজ ও উমরার জন্যই বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেলের সংখ্যাও বেড়েছে। মক্কার কোনো কোনো বিলাসবহুল হোটেলে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত এত দামি রাজকীয় স্যুট আছে, যার জন্য প্রতি রাতে পাঁচ হাজার ডলার পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হয়।
মরক্কো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, আলজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ থেকে আসা হাজিরা অনেকেই দামি ও বিলাসবহুল হোটেলে থাকেন। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশ থেকে হজপালনের জন্য যারা যান, তাদের সিংহভাগই সাধারণ ও মধ্যম মানের হোটেলে থাকেন।
তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারের কল্যাণে এখন বিভিন্ন দেশের হাজিরা দেশ থেকে মুঠোফোনের সিম কার্ড নিয়ে যান। আবার অনেকে মক্কা-মদিনায় গিয়ে সিম কার্ড সংগ্রহ করেন। এখান থেকেও ভালো ব্যবসা হয়।
আবার লেনদেনের জন্য নগদ অর্থের বদলে ইলেকট্রনিক পদ্ধতি বা কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকেও অনেক হাজি ভিসা বা মাস্টার ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যান। কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক হজ প্রিপেইড কার্ড প্রবর্তন করেছে।
আরব নিউজের আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গড়ে প্রতিবছর এক কোটির বেশি হজ ও উমরাযাত্রী সৌদি আরব সফর করেন। হজের পর উমরাযাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মক্কা-মদিনার বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোও প্রাণবন্ত থাকে বছরজুড়ে। মসজিদে হারামের আশেপাশের শপিং মল, বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং দোকানগুলোতে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই থাকে।
এ ছাড়া মিসফালা, আজইয়াদ, আল গাজা, আল জিন, আজিজিয়া, কাকিয়া ও নাক্কাসা এলাকায় বিপুল সংখ্যক বিদেশি যাত্রী থাকেন। মসজিদে হারাম এলাকায় ক্লক টাওয়ারে অবস্থিত হোটেল ও মলগুলিতেও প্রচুর দোকান রয়েছে।
আজিজিয়ার সর্বত্রই দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। জিসিসিভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও বহু আরব দেশ থেকে যাত্রীরা প্রচুর সংখ্যায় উমরা করতে আসেন।
মিসফালার একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের ইনচার্জ ফরিদ মুহাম্মদ জানান, বিদেশিরা তাদের প্রিয়জনের জন্য উপহার, কার্পেট, কৃত্রিম অলঙ্কার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন। অনেকে জামাকাপড় ও গয়না কিনতেও আগ্রহী।
ফরিদ মুহাম্মদ বলেন, দর্শনার্থীদের আগমনে বাণিজ্যিক কেন্দ্রের মালিকরা খুশি।
সাধারণত উমরা মৌসুম চলে ৯ মাস। এ সময় মক্কায় বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তুঙ্গে থাকে। হজের মৌসুমে দেশটির আর্থিক খাতের বড় একটি অংশ আসে হাজিদের কাছ থেকে। এ ছাড়া বছরব্যাপী উমরাযাত্রীদের থেকে পাওয়া রাজস্বও দেশটির অর্থনীতির অন্যতম বড় খাত।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে, অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে সৌদি আরবের যা রাজস্ব আসে, তার থেকেও বেশি অর্থ আসে হজ থেকে। তবে প্রকৃত আয় কত, তার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। অনুমান এবং পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে হজের মোট আয় ধারণা করা হয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই অর্থের বড় অংশ আসে মূলত ট্যাক্স, পারমিট ফি এবং ট্যারিফ খাত থেকে। পাশাপাশি হোটেল, রিসোর্ট, পরিবহন এবং খাবারের মতো পরিষেবা থেকেও আয় করে থাকে দেশটি।
বর্তমানে সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের ট্রাভেল এজেন্সি, এয়ারলাইনস ও পর্যটন খাতে সম্প্রসারিত হয়েছে বাণিজ্যিক সুবিধা।
আগামী বছর উমরা ও হজযাত্রীর পাশাপাশি সৌদি আরবে পর্যটক সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এ বিশাল সংখ্যক দর্শনার্থীর নিরাপত্তা ও অন্যান্য সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবেলার ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।