ইজতেমার বিদেশি মেহমানখানার চালচিত্র

  • নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইজতেমার মাঠ, ছবি: সংগৃহীত

ইজতেমার মাঠ, ছবি: সংগৃহীত

টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় প্রতিবছর পৃথিবীর শতাধিক দেশ থেকে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। ইজতেমা ময়দানের উত্তর পার্শ্বে বিদেশি মেহমানদের জন্য থাকার জায়গা বানানো হয়। সেখানে সর্ব সাধারণের প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, নির্ধারিত পাস ছাড়া সাধারণ কেউ সেখানে ঢুকতে পারে না। তবে ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে জানতে অনেকেই ইচ্ছুক, তাই কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করা হলো।

বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশ থেকে মোট চার ধরনের মেহমান আসেন।
১. ভারত ও পাকিস্তানের রায়বেন্ড মারকাজের মুরুব্বি উলামায়ে কেরাম ও সব দেশের মারকাজের শুরার সাথীগণ।
২. তাবলিগে সময় লাগানো সব শ্রেণির পুরাতন সাথীরা। তাদের সঙ্গে শুধু ইজতেমায় অংশগ্রহণ ও দেখার অনেক নতুন সাথীও আসেন।
৩. বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ। মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশের শরিয়া বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় আলেমও অংশগ্রহণ করেন।
৪. প্রবাসী বাংলাদেশি, যারা শুধুমাত্র ইজতেমার উদ্দেশ্যে দেশে আসেন।

বিজ্ঞাপন

থাকার ব্যবস্থা
মুরুব্বি ও শুরার সাথীদের থাকার ব্যবস্থা টঙ্গী ময়দানে নির্মিত স্থায়ী মাদরাসায় করা হয়। এখানে ভিন্ন ভিন্ন কামরায় তারা অবস্থান করেন। মাদরাসার বড় হলরুমে সবদেশের মুরুব্বি ও শুরার সাথীদের অংশগ্রহণে প্রতিদিন মাশওয়ারা (পরামর্শ) হয়। এখানে ইজতেমার প্রতিদিনের কারগুজারি (কাজের ফিরিস্তি) শোনানো ও দায়িত্ব বা কাজ বন্টন, সবদেশের কাজের চিত্র নিয়ে পর্যালোচনা, বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করা হয়।

সাধারণ সাথীদের জন্য মৌলিকভাবে ৪টি অস্থায়ী টিনশেড ও তাঁবু বানানো হয়। একটিতে আরব, আফ্রিকা ও রাশিয়ার দেশসমূহ। দ্বিতীয়টিতে পূর্ব এশিয়া (চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য), ইউরোপের দেশসমূহ। তৃতীয়টিতে দক্ষিণ এশিয়া (ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা)। এছাড়া স্থান সংকুলান না হলে চতুর্থ তাঁবুও ব্যবহার করা হয়।

তাঁবু ব্যবস্থাপনা
বিদেশি মেহমানদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কয়েক হাজার মানুষ সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়োজিত থাকেন।

বিজ্ঞাপন

জিম্মাদার
প্রতি টিনশেডে-তাঁবুতে কাকরাইল শুরার পক্ষ থেকে জিম্মাদার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তারা পুরো ইজতেমায় উপস্থিত মেহমানদের যাবতীয় বিষয়ের তদারকি করেন।

ইজতেমার মাঠের বিদেশি তাঁবু, ছবি: সংগৃহীত

ট্রান্সপোর্ট
মেহমানদের আনা-নেওয়া ও যাতায়াতের জন্য আলাদা একটি জামাত কাজ করে। কাকরাইল মসজিদের নিজস্ব গাড়িসহ ইজতেমা উপলক্ষে শতাধিক গাড়ি ব্যবহারের জন্য দিয়ে থাকেন জিম্মাদার সাথীরা। তন্মধ্যে ‘বিদেশি মেহমানদের খেদমতে নিয়োজিত’ স্টিকার সম্বলিত গাড়িগুলো এয়ারপোর্ট টু ময়দান নির্বিঘ্নে চলাচলের সুবিধা পায়।

ইস্তেকবাল (অভ্যর্থনা)
বিদেশি তাঁবুর প্রবেশমুখে ইস্তেকবালের (অভ্যর্থনা) কামরা রয়েছে। এখানে দায়িত্ব পালনরত জামাতের সাথীরা এয়ারপোর্ট থেকে আগত মেহমানদের ইস্তেকবাল করে তাদের লাগেজ এবং অন্যান্য মাল-সামানা আনা-নেওয়ার কাজে সহায়তা করেন। পাশাপাশি প্রত্যেকের পাসপোর্ট এন্ট্রি করা হয়।

আমানত
বিদেশি মেহমানদের পাসপোর্ট, টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী জমা রাখার জন্য আমানতের কামরা রয়েছে। এখানে ব্যাংকের লকারের মতো প্রত্যেকের নামে বিশেষ লকারে তাদের আমানত সংরক্ষণ করা হয়।

বয়ান তরজমা
বিদেশিদের মধ্যে যারা মূল উর্দু বয়ান বুঝেন না, তাদের বোঝার সুবিধার্থে দশের অধিক ভাষায় মাঠের বয়ান তাৎক্ষণিক অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়। রায়বেন্ড মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপনকারী বিদেশি আলেমরাও তরজমায় অংশ নেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের অনেক আলেম, বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষকও বয়ান তরজমা করে থাকেন।

তাশকিল
তাবলিগের কাজের জন্য বের হতে উৎসাহ দেওয়াকে তাশকিল বলে। ইজতেমায় বিদেশিদের অধিকাংশই এক বা একাধিক চিল্লায় সময় লাগানোর নিয়তে আসেন। তাদের জামাতবন্দি করা, মুতারজিম (অনুবাদক) ঠিক করা ও জামাতে পাঠানোর যাবতীয় কাজ করেন তাশকিলের সাথীরা।

ইজতেমায় বিদেশি সাথী, ছবি: সংগৃহীত

প্রয়োজন পূরণের জামাত
নানা বয়সী মেহমানদের বিভিন্ন রকম সমস্যা ও প্রয়োজন থাকে। এসব সমস্যা সমাধান ও প্রয়োজন পূরণের জন্য ‘মাসয়ালা হল’ নামে জামাত রয়েছে। তারা এই খেদমত আঞ্জাম দেন।

পাহারা
স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের উদ্যোগে বিদেশি তাঁবুর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলেও ইজতেমার পক্ষ থেকে পাহারা জামাত নিয়োজিত থাকে। পালাক্রমে চব্বিশ ঘণ্টা মূলগেট ও প্রত্যেক তাঁবুতে পাহারা দেওয়া হয়।

অস্থায়ী দোকান
এই দোকানে বেডিং, মশারি, কম্বল, জুতাসহ সকল প্রকার ফল ও পানীয় সুলভমূল্যে বিক্রি করা হয়।

মানি এক্সচেঞ্জ
মেহমানদের কষ্টলাগব ও প্রতারণা থেকে বাঁচাতে ময়দানেই অস্থায়ী মানি এক্সচেঞ্জ বসানো হয়। সব ধরনের মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের সুবিধা থাকে এখানে।

পরিচ্ছন্নতা
তাঁবু থেকে বর্জ্য অপসারণ ও টয়লেট-অজুখানা-গোসলখানা পরিস্কারের জন্য কয়েকটি জামাত থাকে। প্রতিদিন রাত ১২টার পর এই জামাতের সাথীরা সব ধরনের পরিচ্ছন্নতার কাজ আঞ্জাম দেন। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সময়ও তারা সেবা দেন।

উল্লেখ্য, ইজতেমার মাঠে নিয়োজিত কাজের জামাতে ৩ চিল্লা দিয়েছেন এমন সাথীদের নির্বাচন করা হয়। প্রত্যেক বিভাগ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সবকিছু তারা নিজেরাই ব্যবস্থা করেন এবং আলমি শুরার ইজতেমার মোট ছয় দিন (আগ-পর) সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে মেহমানদের খেদমত করেন।

ইজতেমার মাঠের বিদেশি তাঁবু, ছবি: সংগৃহীত

খাবার ব্যবস্থাপনা
অতিথি পরায়ণ জাতি হিসেবে বাংলাদেশিদের বিশেষ সুনাম রয়েছে বিশ্বময়। এরই ধারাবাহিকতায় ইজতেমায় আগত মেহমানদের সর্বোচ্চ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি পরিবার বংশানুক্রমে এই খেদমতের জিম্মাদারি পালন করে থাকেন। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগে প্রায় হাজারখানেক স্বেচ্ছাসেবক শরিক হন।

বিশেষ মেহমানখানা ও সাধারণ মেহমানখানার আয়োজন পৃথকভাবে হয়। দুই স্থানেই দেশের ভিন্নতা হিসেবে পছন্দমাফিক খাবার পরিবেশন করা হয়। সেই সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা চা-কফির ব্যবস্থা থাকে।

সাধারণ মেহমানখানার খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে থাকেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আর রুটি বানানোর কাজে অংশ নেন কাকরাইল মাদরাসার ছাত্ররা।

ইজতেমার কয়েকদিনে প্রায় সাত টন চাল, আট টন গরুর গোশত, পাঁচ টন মুরগি, পাঁচ টন মাছ, এক টন খাসির গোশত, পাঁচ টন সবজি, দেড় লাখ রুটিসহ অন্যান্য বেকারি আইটেম ও এক লাখ লিটার খাবার পানি ব্যবহৃত হয়। যার ব্যয় মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা।

খাবারের বিশুদ্ধতা ও উৎকৃষ্ঠ মান নিশ্চিত করার লক্ষে সবকিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত-খামার থেকে ফরমালিন মুক্তভাবে আনা হয়। খাবার পানি গভীর নলকূপ থেকে উঠিয়ে ফিল্টারিং করে বোতলজাত করা হয়।

আরেকটি কথা, অনেকেই মনে করেন আলমি শুরার ইজতেমার এই বিশাল আয়োজনে অর্থের যোগান বিদেশ থেকে হয়। এটা একেবারেই ভিত্তিহীন ও অমূলক ধারণা। যাবতীয় খরচ তাবলিগে সময় লাগানো স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় আল্লাহর রাস্তায় আগত মেহমানদের জন্য ব্যয় করে থাকেন।