নিয়ম বহির্ভূতভাবে সাইলোতে চালের বদলে গম

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

পুষ্টিগুণ অটুট রাখতে ও কয়েক বছর চাল সংরক্ষণ করতে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় সাতটি চাল সংরক্ষণাগার বা সাইলো নির্মাণ করছে খাদ্য অধিদপ্তর। এরমধ্যে দেশের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদন এলাকা ময়মনসিংহের সাইলোটির পাশাপাশি টাঙ্গাইলের সাইলো উদ্বোধন হয়ে গেছে। আর উদ্বোধনের পর থেকেই শুরু হয়েছে অনিয়ম। চালের জন্য প্রস্তুত করা সাইলোতে রাখা হয়েছে গম।

আপাতদৃষ্টিতে নতুন এসব সাইলোতে 'চালের বদলে গম' রাখার বিষয়টি ছোটখাটো হেরফের মনে হলেও এরমধ্যে রয়েছে বড় জালিয়াতি। কারণ আধুনিক ওইসব সাইলোতে চাল রাখলে সেটার হিসেবে হেরফের করা কঠিন। যা দীর্ঘদিন ধরে থানা ও জেলাগুলোর খাদ্যগুদামে (এলএসডি/সিএসডি) চলে আসছে। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাবে চাল সংগ্রহ ব্যবস্থায় মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের বড় উৎকোচ। এছাড়া সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরাতন চাল নতুন বলে ক্রয় দেখানো সম্ভব হবে না। যে কারণে আধুনিক সাইলোতে এখন চালের বদলে গম।

বিজ্ঞাপন

এদিকে সম্প্রতি ময়মনসিংহের সাইলো পরিদর্শন করেছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল। তারা চালের সাইলোতে গম দেখে অবাক হয়েছেন। বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সাইলো কর্তৃপক্ষের কাছে। কারণ ওইসব সাইলোতে গম রাখার প্রযুক্তিগত সুবিধা-ই নেই। যা বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিস্ফোরণের আশংকাও রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ সাইলোগুলো নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। প্রথমে আটটি সাইলো নির্মাণের কথা থাকলেও শেষে নওগাঁর সাইলো বাদ দিয়ে এখন বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মহেশ্বরপাশা, চট্টগ্রাম ও মধুপুরে ৪.৮৭ লাখ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণ হচ্ছে। বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, যেমন ঘন ঘন জলবায়ু বিপর্যয়, বন্যাসহ নানা মহামারির মতো সঙ্কটে খাদ্য ঘাটতি থেকে মুক্তি দেওয়া এ প্রকল্প উদ্দেশ্য ছিল। যা শুরুতেই লক্ষ্যহীন হয়ে গেছে।

এখন জানা যাচ্ছে, ময়মনসিংহের সাইলোর পাশাপাশি টাঙ্গাইলের মধুপুরসহ আরও কয়েকটি সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। যেজন্য তড়িঘড়ি করে গত জুনে ও সেপ্টেম্বরে দুদফায় ২০ হাজার টন গম চলাচল সূচি জারি করা হয়েছে।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিনিধি দল যখন রাইস সাইলো পরিদর্শনে গিয়েছেন তখন তারা দেখেছেন সাইলোর পরিচ্ছন্ন টাওয়ার না থাকায় ডাস্ট (ধুলা-ময়লা) দিয়ে বিল লাইনার পুরোপুরি ব্লকড হয়ে গেছে। চিলার ও ফিউমেগেশন প্রক্রিয়া পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে। ২০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৮ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এ স্টিল রাইস সাইলো শুরুতেই এ অবস্থা।

চালের সাইলোতে প্রযুক্তিগত কারণে গম রাখা সম্ভব নয়-এ বিষয়টি প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ দায়িত্বে থাকাকালে তার ওএমটি রিভিউ রিপোর্টের প্রেজেন্টেশনেও বলেছিলেন। তারই ওই প্রেজেন্টেশনের তথ্য বলছে, সাইলোতে বিকল্প কোনো পণ্য রাখা হলে ম্যাকানিক্যাল যন্ত্রাংশগুলো সঠিক ফ্লো রেটে কাজ করবে না। কিছু কিছু যন্ত্রাংশ শস্য বিনষ্ট করতে পারে। বাকেট এলিভেটরগুলো সঠিকভাবে কাজ নাও করতে পারে। চালের সাইলোর পরিচ্ছন্ন করার যন্ত্রগুলো গমের সাইলোর জন্য সঠিক নয়। এমনকি বিস্ফোরণের আশংকা বেড়ে যেতে পারে।

ময়মনসিংহের সাইলোরও একই অবস্থা। যদিও বিষয়টি খাদ্য অধিদপ্তর জানতো। গত জুন মাসে ময়মনসিংহ স্টিল রাইস সাইলোর সুপার খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, চালের সাইলোতে পরিচ্ছন্ন টাওয়ার না থাকায় গম ডাস্টমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। চিলার ও নাইট্রোজেন ফিউমিগেশন কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন সাইলো সুপার।

এমন অবস্থায় বিশ্বব্যাংক এসে বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন। এ বিষয়ে ওই সাইলো সুপার মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ খান শিবলী বলেন, তারা (বিশ্বব্যাংক) এটা অর্থায়ন করেছে, তাদের বলা হয়েছে এটা চালের জন্য। সেখানে অন্যকিছু রাখলে তারাতো উদ্বেগ দেখাবেই।

তিনি বলেন, এতে কিছু ঝুঁকি আছে। তারা (প্রতিনিধি দল) জিজ্ঞেস করেছে-এটাতে কেন গম রেখেছেন? আসলে এটা প্রকল্প থেকে বলা হয়েছে আমাদের যে এখানে গম রাখা যাবে। আমরা সেটা প্রতিনিধিদের বলেছি। তারা বিস্মিত হয়েছে। কোনো যান্ত্রিক পরিবর্তন না করেই চালের সাইলোতে গম রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলে জানান তিনি।

খাদ্য অধিদপ্তরের এ বিষয়গুলো দেখেন চলাচল সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগ। যার পরিচালক মাহবুবুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বললেন, এটার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া আছে। প্রকল্পের যে টেকনিক্যাল কমিটি তারা বলেছে, গম রাখা যাবে। যেহেতু আমাদের গমের সাইলো কম, সেজন্য দুটি সাইলো, সেগুলো চালের জন্য করা হলেও পরে গম রাখার জন্য অনুমোদন দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ছাড়া এবং বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদলের উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করলে এ প্রকল্পের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আমরা টেকন্যিকাল পারসন নয়। আমাদের বলেছে রাখা যাবে, আমরা রাখছি।

পরিচালকের কথা শুনে বোঝা যায়, মন্ত্রণালয় এ কাজের অনুমোদন দিয়েছে। কোনো এক টেকনিক্যাল কমিটি এটার জন্য সুপারিশ করেছে।

তবে খোঁজ নিয়ে অবাক বিষয় জানা গেল। প্রকল্পের সাবেক পরিচালক রেজাউল করিম শেখ, যিনি প্রকল্পের শুরুতে বলেছিলেন এটা ঝুঁকিপূর্ণ তিনিই ওই টেকনিক্যাল কমিটিতে ছিলেন। আরও ছিলেন প্রকল্পটির একজন কনসালটেন্ট, যিনি সাবেক সাইলো প্রকৌশলী। তারা কোনো প্রকার পরীক্ষা-নীরিক্ষা না করেই একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন মন্ত্রণালয়ে।

তখন থেকেই খাদ্য কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সুবিধাবাদি সিন্ডিকেটের কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য উদ্দেশ্যে এ প্রতিবেদন দিয়েছেন তারা।

এবার কথা হয় সাবেক প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম শেখের সঙ্গে। দুই দফায় সাংঘষিক তথ্য কেন দিলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, গমের সাইলোতে চাল রাখা যাবে না, চালের সাইলোতে গম রাখা যাবে। প্রকল্প শুরুতে আমি আগে কি বলেছি মনে নেই।

তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে কোনো সাইলোতে দীর্ঘমেয়াদি গম রাখার কথা অনুমতির কথা বলিনি। পরীক্ষামূলকভাবে রাখা যাবে সেটা বলেছি। এখন আমি নেই। যদি বর্তমান প্রসাশন মনে করে এটা রাখা ঠিক নয়, তাহলে চাল রাখবে।

জানা গেছে, দেশে চাল উৎপাদনের ময়মংসিংহ প্রসিদ্ধ। এ বিভাগে ১.১৯ লাখ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার ফ্ল্যাট গোডাউন (আগের খাদ্যগুদাম) রয়েছে। যেখানে চাল সংরক্ষণের একটি বড় কর্মযজ্ঞ চলে। এতে সংগ্রহীত চাল সরবরাহ, বস্তা ক্রয়, গোডাউনে খামাল করা এবং সেখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় পরিবহনসহ নানা কাজে রয়েছে সরকারের বড় বরাদ্দ। এছাড়া কর্মকর্তারা এখান থেকে মিলার ও পরিবহন ঠিকাদারদের বড় উৎকোচ পান। পাশাপাশি সংগ্রহ মৌসুমে চাল না কিনেও পুরাতন চাল নতুন বলে ক্রয় দেখানোর মতো অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মানহীন চাল ফ্লাট গোডাউনে রাখা যায়, যা আধুনিক সাইলোতে সম্ভব নয়।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, চালের সাইলোতে গেলে এসব দুই নাম্বারি বন্ধ হয়ে যাবে। সব আটোমেশন হবে। চুরি করা যাবে না। তাই চালের বদলে গম ঢুকিয়ে এক ধরণের চালাকি করেছে খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেট।

তিনি আরও বলেন, সাবেক প্রকল্প পরিচালকের দাবি করেন তখন পরীক্ষা করার জন্য চাল পাওয়া যাচ্ছিলো না। তাই পরীক্ষা করার জন্য গম রাখা হয়েছে কিন্তু একই সময় চলাচল সংরক্ষণ ও সাইলো বিভাগের তথ্য বলেন যে, মন্ত্রণালয় ও টেকনিক্যাল টিমের অনুমোদনেই গম রাখা হচ্ছে, তাহলে চাল পাওয়া যাচ্ছিলো না কেন? টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও পরিচালক মাহাবুবুর রহমানের কথায় বিভ্রান্তি রয়েছে।

প্রকল্পে কর্মরত দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে চলা অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহ কেন্দ্রিক দুর্নীতির সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্রভাব ও মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় চালের সাইলোতে গম রাখার বিষয়ে প্রকল্প অফিস থেকে মতামত প্রদান করা হয়েছে। এভাবে প্রতিটি সংগ্রহ মৌসুমে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র। এতে একদিকে যেমন জনগণের টাকা অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সাইলোর যন্ত্রাংশ ও রক্ষিত গম নষ্ট হচ্ছে।