গাইবান্ধায় ঝিনুক পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী চুন

  • মাসুম বিল্লাহ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাইবান্ধা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাদিয়াখালি ইউনিয়নের রিফাইত সরকারতারি গ্রামে এখনো টিকে আছে ঝিনুক পুড়িয়ে পান খাওয়ার চুন তৈরির ঐতিহ্য। বংশানুক্রমে এ পেশায় নিয়োজিত তিনটি সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবার তাদের পূর্বপুরুষদের শেখানো পদ্ধতিতে চুন তৈরি করে আসছে আজও। তাদের তৈরি চুন চাহিদা পূরণ করছে স্থানীয়দের। তবে, ক্ষুদ্র এই শিল্প সম্প্রসারণে প্রয়োজন সরকারি সহায়তা।

ঝিনুক থেকে চুন তৈরির পদ্ধতি হাজার বছরের পুরনো। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। পরে চীনা এবং রোমান সভ্যতায় এটি আরও উন্নত হয়। প্রাচীন ভারতে চুন ব্যবহৃত হতো পানীয় ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে পান চিবানোর ঐতিহ্যের সাথে চুনের ব্যবহার শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতক আগে। এটি তখন থেকেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের একটি প্রতীক।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে সদর উপজেলার বাদিয়াখালি ইউনিয়নের রিফাইত সরকারতারি গ্রামে দেখা যায়, চুন তৈরির বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত যোগী পরিবারগুলো। যারা চুন তৈরি করে থাকেন স্থানীয়ভাবে তাদেরকে যোগী বা চুনারু বলা হয়। কেউ কেউ বলে থাকেন চুনি। চুন তৈরিতে কর্মব্যস্ত থাকেন যোগী পরিবারের নারী-পুরুষ উভয়ই।


চুন তৈরির পদ্ধতি

বিজ্ঞাপন

চুন তৈরির মূল উপকরণ ঝিনুক। যেটাকে সিঁপি বলা হয়। এই সিঁপি বা ঝিনুক থেকে চুন তৈরির প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ও শ্রমনির্ভর হলেও প্রাকৃতিক ও বিজ্ঞানসম্মত। ঝিনুক সংগ্রহ করা, ছোট আকারে খরি কেটে রোদে শুকানো, ভাটা সাজানো ও আগুনে পোড়াসহ চুন তৈরির মূল প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে বেশ কয়েকদিন ।

চুন তৈরির প্রথমে জেলার বিভিন্ন নদী, বিশেষ করে গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি এলাকা থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করেন যোগীরা। এ ঝিনুক পানিতে পরিষ্কার করে বিশেষভাবে তৈরি ভাটিতে সাজানো হয়। খরি ও ঝিনুক স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা ধরে আগুনে পোড়ানো হয়। পোড়ানো ঝিনুক থেকে তৈরি হয় ‘ঝুড়ি’, যা চুন তৈরির প্রধান উপাদান। পরে আধুনিক শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ব্লেন্ডার মেশিনে এই ঝুড়ি ও পানি মিশিয়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধরে ঘষামাজার মাধ্যমে তৈরি হয় চুন। পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেন যোগী পরিবারগুলো।

চ্যালেঞ্জ ও সংকট

একসময় এই পেশায় নিয়োজিত যোগীদের সংখ্যা বেশি থাকলেও নানা সংকটের কারণে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। বর্তমানে এ গ্রামের সুভাস চন্দ্র দেবনাথ, বর্ণ চন্দ্র দেবনাথ ও স্বপন চন্দ্র দেবনাথ- এই তিন ভাই তাদের পরিবারসহ বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছেন। সরকারি সহযোগিতার অভাব, উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি টিকে থাকা পড়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে।

উন্নয়নে সরকারি সহযোগিতার প্রয়োজন

এই প্রাচীন শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। যোগী পরিবারগুলোর দাবি, আধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ এবং সুষ্ঠু ঋণ সুবিধা পেলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প নতুন মাত্রা পাবে। গাইবান্ধার রিফাইত সরকারতারি গ্রামের চুন তৈরি প্রক্রিয়া একদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক, অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রকৃতির অপূর্ব মেলবন্ধন। এটি কেবল একটি পেশা নয়; বরং বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। তাই এই শিল্প রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার দাবি স্থানীয় সচেতন মহলের।

বিজ্ঞান ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন

ঝিনুক থেকে চুন তৈরি বিজ্ঞানসম্মত ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ঝিনুকের প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম কার্বোনেট তাপে ভেঙে ক্যালসিয়াম অক্সাইডে পরিণত হয় এবং পানি মিশ্রণে তা ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইডে রূপান্তরিত হয়, যা চুন নামে পরিচিত।


চুন শুধু পানের স্বাদ বাড়ায় না; এটি হজমেও সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত চুনের ব্যবহার মুখগহ্বর ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

রিফাইতপুর গ্রামের যোগী শ্রী স্বপন চন্দ্র দেবনাথ বলেন, আমরা বাপ দাদার পেশা ধরে রেখেছি। সময়ের সাথে সাথে এটি টিকিয়ে রাখা কঠিন হচ্ছে। তবে সরকারি আর্থিক সহযোগিতা- বিনা সুদে ঋণ কিংবা স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে আমরা আমাদের শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে পারতাম। আগে অনেক পরিবারই চুন তৈরি করতো কিন্তু নানা সংকটের কারণে পেশা বদল করেছেন অনেকে।

স্বপন চন্দ্র দেবনাথের স্ত্রী আরতী দেবনাথ বলেন, আমরা পরিবারের সবাই চুন তৈরির কাছে সহযোগিতা করে থাকি। সেজন্যই টিকে আছি। এই কাজে অনেক পরিশ্রম আছে। আমাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।

একই গ্রামের অপর যোগী শ্রী বর্ণচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ঝিনুক থেকে এই চুন তৈরি করে থাকি আমরা। এই চুন স্থানীয় বাজারে আমরাই সরবরাহ করে থাকি। প্যাকেটজাত করে একেবারে প্রস্তুত করে দোকানে পৌঁছে দেই। চাহিদা আছে আমাদের চুনের।

মাত্র ছয়জন যোগীকে প্রায় ১০ লাখ টাকা কুটির শিল্প ঋণ প্রদানের কথা জানালেও জেলায় যোগীর সংখ্যা কত তা জানাতে পারেনি গাইবান্ধার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গাইবান্ধা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন মহা ব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল ফেরদৌস মুঠোফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা জেলার ৬ জন যোগীকে প্রায় ১০ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছি।

তবে, এসময় জেলায় মোট কতজন যোগী রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা (ইউএনও) মাহামুদ আল হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, জেলার ছোট ছোট এধরণের শিল্পের প্রসারে সব ধরণের সহযোগিতা করবে উপজেলা প্রশসান। আমরা শিগরিই তাদেরকে ডেকে তাদের সাথে কথা বলবো এবং তাদের এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।