কালো জলরাশির ওপর একের পর এক সাজানো নৌকায় রঙিন সবজিতে ভোরের সূর্যের কিরণ সোনালি রং দেওয়ার চেষ্টা করলেও, আশেপাশের ময়লা আবর্জনায় তা মলিন। তবে যুগের পর যুগ এই নোংরা পানি আর আবর্জনায় মাঝেই সোনালি বাণিজ্য অন্য জুটিয়েছে দিন মজুররা। বুড়িগঙ্গার এই কালো জলের স্রোত কাউকে বানিয়েছে কোটিপতি, আবারও কারও মাথার ঝুড়ির বোঝা দ্বিগুণ করেছে। তবে বাণিজ্যের কদর খুব একটা হেরফের হয়নি এখানে।
বুড়িগঙ্গার নৌ-পথকে পুঁজি করে ১৭৪০ সালে ঢাকার নায়েবে নাজিম নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের সময় ফরাসি বণিকদের প্রতিষ্ঠিত ছোট্ট ‘গঞ্জ’ বা ‘বাজার’ প্রায় ৩০০ বছর ধরে বাণিজ্য ধরে রেখেছে। কালের বিবর্তনে বাণিজ্যের ধরণ বদলেছে। বদলেছে ব্যবসার রঙ। গঞ্জের নামও হয়েছে বৃহৎ 'শ্যামবাজার'।
রাত হলেই ব্যস্ততা শুরু হয় এই শ্যাম বাজারে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্যবাহী ট্রাক আসে। ব্যস্ততা শুরু হয় শ্রমিকদের। নাম মাত্র শ্রমের মূল্যের রাতভর বস্তা টানে দীন-দারের কঠোর দেহ।
তবে প্রাচীন নৌপথ ধরে এখনো পণ্য আসে শ্যামবাজারে। যা অনেকটা কৃষকের খেতের টাটকা সবজি নাম পরিচিত। ভোরের আলো ফুটতেই দৃশ্যমান হয় সেই ভাসমান বাণিজ্যের।
বর্তমানে খেয়ানৌকা, লঞ্চ ও স্টিমারের শ্যামবাজার ঘাটের জায়গা দখল করে নিয়েছে সড়কপথে ট্রাক, বাস। তবুও এখনো নৌপথে বিক্রমপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে কৃষিপণ্য আসে শ্যামবাজার ঘাটে।
পণ্য খালাসের সাথেই ব্যবসায়ীরা জড়িয়ে পড়ে দর-দামের তর্কে। সবজির দামে জিতে নৌপথেই বাণিজ্যের পরের গন্তব্য খোঁজে অনেকে৷ তবে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী স্থানীয় মিন্তির সাহায্য নিয়ে পণ্য তোলে সড়কে। সেখান থেকেই এসব পণ্যের যাত্রা শুরু হয় ভোক্তার নীড় পর্যন্ত।
শ্যামবাজার এই ঘাট ঘিরে ভাসমান মানুষের আনাগোনা যেমন তেমনি ক্ষুদ্র ব্যবসায় সংসারের হাল ধরেছে অনেকে। তাদের মধ্যে হামিলা (ছদ্মনাম) একজন। হালিমার বাহারী চিতই পিঠার স্বাদ নিয়ে সকালের শুরু হয় এই ঘাটের মাঝি ও ব্যবসায়ীদের।
ছিন্নমূল মানুষও বাণিজ্য খোঁজে এই শ্যামবাজার ঘাটে। বুড়িগঙ্গার পানিতে ভাসা সবজিই তাদের পুঁজি। কুড়ানো সবজিতেই লাভ খোঁজে আকলিমা-মনিরা মত নারীরা। সবজি কুড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত করে বাদ দিয়ে যা থাকে তা বিক্রি করে ঘরে ফিরে তারা। আবারও ফজরের আজানের সাথে ঘাট দখলে বের হয় আকলিমা-রা ।
প্রকৃতির বৈচিত্র্যতায় নানা মনের মানুষ ঘুরে বেড়ায় পথে প্রান্তরে। তবে আবুল কালাম ভিন্ন। কয়েক যুগ কাটিয়ে দিয়েছেন এই শ্যামবাজারে। ছেড়া গেঞ্জির দিকে নজর না থাকলেও চশমা আর টুপি তার সাজের প্রধান উপকরণ। মর্তের রাজনীতিতে তার খেয়াল নেই। কোনো রকম দিন গেলেই নতুন আনন্দের খোঁজ করেন তিনি। দুঃখ কষ্ট অনুভূতি খুব একটা নেই তার। প্রকৃতির মাঝে অন্তত উপলব্ধির জন্য হলেও প্রয়োজন আছে এমন মানুষেরও!
আগে রাজধানী ঢাকার ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শ্যাম বাজার। তবে কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, টঙ্গি, বাইপাইল, মিরপুর, মহাখালীতে পাইকারি বাজার গড়ে ওঠার কারণে জৌলুস কমেছে শ্যামবাজারের।
যদিও এখনো রাজধানীর সব থেকে বড় ও প্রাচীন পাইকারি বাজারের আড়ত এই শ্যামবাজারই। গড়ে উঠেছে পেঁয়াজ রসুনের বড় বড় আড়ত। মূলত ভিনদেশ থেকে নৌপথেই এসব পেঁয়াজ রসুন আসে এখানে৷ শ্যামবাজারের পর্যটক গাড়িও যেন পরিণত হয়েছে গণপরিবহণে। সব মিলে জৌলুশ ধরে টিকে থাকার লড়াই করছে এক সময়ের গঞ্জের ঐতিহ্য।