'২০২৪ সালে গণতন্ত্র বেঁচে আছে নাকি মরেছে'
২০২৪ সালের বিদায়ের লগ্নে প্রশ্ন উঠেছে: গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" টিকে আছে? কারণ, বছরটি ছিল নির্বাচনের। বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ভোট দিয়েছেন। সিংহভাগ দেশে নির্বাচনও সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের বছরে গণতন্ত্র কতটুকু সুসংহত হয়েছে, এমন প্রশ্ন পণ্ডিতদের মনে সঞ্চারিত হয়েছে।
কেন নির্বাচনের বছরে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন? কারণ একাধিক। নির্বাচন বহু দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার বদলে স্বৈরতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করেছে। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে একনায়কতন্ত্র দখল করেছে রাজনীতি। যার প্রতিফল হলো গণঅসন্তোষ। গণআন্দোলন। রক্তাক্ত পথে ক্ষমতার পালাবদল। ফলে নির্বাচনের বছরে প্রধান চরিত্র হয়েছে স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলন। বছরের মধ্য থেকে শেষার্ধে বাংলাদেশ থেকে সিরিয়া পর্যন্ত দেখা গেছে এমনই দৃশ্যপট। ইকোনোমিস্ট বছরের সেরা দেশের তকমা দিয়েছে রক্তাক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিবাহী বাংলাদেশকে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া রেসা কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, "২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্ব জানবে গণতন্ত্র বেঁচে আছে নাকি মরেছে।" তার মতে, ২০২৪ সালে, "নির্বাচনের বছর"-এ বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা ভোট দেবে। কিন্তু ভোটারদের এই ঢেউ ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ হিসাবে ব্যালট বাক্সের দিকে যাবে, নাকি বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদী প্রভাব, বিদেশী তথ্যের কারসাজি এবং প্রযুক্তির নতুন ফর্ম-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপন্ন করার জন্য "একটি নিখুঁত ঝড়" হিসাবে বিবেচিত হবে? বছরটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রশ্ন করার সময় আসবে পারে: গণতন্ত্র কেমন চলছে? আর তখনই বলা হবে, গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" টিকে আছে বা ছিল? যেমনটি জার্নাল অব ডেমোক্রেসিতে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর ডেমোক্রিটিক স্টাডিজ-এর পরিচালক জন কে গ্যালেন Is Democracy Surviving the “Year of Elections”? শিরোনামের এক প্রবন্ধে।
গণতন্ত্র ক্ষুন্ন হয়েছে এজন্য যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো স্বচ্ছ ও অবিতর্কিত চরিত্র ধরে রাখতে পারে নি। এর নেপথ্যে রয়েছে তিনটি প্রবণতা:
প্রথমত, গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদী শাসন বৈধতার বিভ্রম তৈরি করতে জাল নির্বাচনের উপর নির্ভর করেছে।
দ্বিতীয়ত, ভোটের মাঠে গণতন্ত্রগুলো বিদেশী তথ্যের কারসাজির চ্যালেঞ্জ থেকে প্রভাব মুক্ত থাকতে পারে নি।
তৃতীয়ত, নির্বাচনের উপর নতুন জেনারেটিভ-এআই সরঞ্জামগুলোর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ ব্যাপক হয়েছে এবং এটিও স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে AI এর আসল হুমকি তাদের ভোট পরিবর্তন করার জন্য লোকেদের প্রতারণা করার ক্ষমতা, যা নির্বাচন এবং গণতন্ত্র সংক্রান্ত বিশ্বাসকে দুর্বল করেছে।
এসব কারণেই ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ-র একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, জরিপ করা উনিশটি দেশের মধ্যে এগারোটিতে, অর্ধেকেরও চেয়েও অনেক কম লোক বিশ্বাস করে নি যে, তাদের দেশে সাম্প্রতিকতম নির্বাচন "অবাধ ও সুষ্ঠু" হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দ্বারা নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার এবং জোরপূর্বক নিজেদের বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টাগুলো প্রত্যক্ষ করেছে, যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
অধিকাংশ নির্বাচনেই বিরোধী, মধ্যপন্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয় নি। সরকারে আসীন কর্তৃত্ববাদীরা নিজেদের শুধুমাত্র একতরফা নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সীমাবদ্ধ রাখে নি। বরং তারা নির্বাচনকে "তথ্যের কারসাজির জন্য যুদ্ধক্ষেত্র" হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তদুপরি, সরকারিভাবে প্রশাসনিক শক্তি এবং বেসরকারিভাবে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিপক্ষকে এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে, নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য হয় এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে নির্বাচনের পথ ধরে গণতন্ত্রের বা জনমনের বিকাশের বদলে কর্তৃত্ববাদের পুনর্বাসন হয়েছে। যেজন্য বিশ্বব্যাপী এই প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে যে, গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" টিকে আছে?
সামগ্রিকভাবে, নির্বাচনী বছর ২০২৪ সালে গণতন্ত্রের ছবিটি খুবই ধূসরিত ও ঝাপসা। কর্তৃত্ববাদ, স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কবাদ কবলিত হয়ে নির্বাচনের পবিত্রতা এবং গণতন্ত্রের শক্তির ব্যাপক পতন হয়েছে ২০২৪ সালে। এমন ন্যাক্কারজনক তথ্যও ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-এর রিপোর্টে দেখা যায়, একটি বিরোধী দল অপ্রত্যাশিতভাবে সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি অংশ জিতেও ক্ষমতাসীনদের দ্বারা সরকারে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়।
ফলে নির্বাচনের বছরটি বাস্তব পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে বলা যাবে না। এটি নিছক নির্বাচনের বছর এজন্য যে এ বছর অনেকগুলো নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনগুলো গণতন্ত্রের বিকাশ ও শক্তি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার বদলে কর্তৃত্ববাদীদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। প্রার্থীদের বিপদের পাশাপাশি নাগরিকদের ভোটদানের মুহুর্তগুলো ছিল আক্রান্ত আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল বিপন্ন, যা নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। বহু ক্ষেত্রে সহিংসতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং এমন সব কাজ করা হয়েছে, যা মৌলিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।
অতএব, গণতন্ত্র কি "নির্বাচনের বছর" টিকে আছে বা ছিল মর্মে যেসব প্রশ্ন বছর শেষে উঠতে তা বহুলাংশেই যথার্থ। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর এবং নির্বাচন ও গণতন্ত্র সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ দেখানো বিদায়ে পথে চলা ২০২৪ সালের পক্ষে দেওয়া আর সম্ভব হবে না। উত্তর ও উত্তরণের পথ ও পন্থা পাওয়া সম্ভব হবে আগত ২০২৫ সালে এবং সামনের অনাগত বছরগুলোতে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।