নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করতে চায় মন্ত্রণালয়!

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ,  স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শিল্পকারখানা ও ক্যাপটিভের নতুন সংযোগে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। দর নির্ধারিত না করে আমদানিকৃত এলএনজির খরচ যতো পড়বে সেই দর আদায় করতে চায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। পুরাতন শিল্প কারখানায় লোড বাড়াতে চাইলেও গুণতে হবে দ্বিগুণ মূল্য।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে দাম বাড়বে, আর কমে গেলে কমবে। দুই ধরণের দর প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুমোদিত (প্রতিশ্রুত) কিন্তু সংযোগ চালু হয় নি এমন গ্রাহকদের এক রকম দর, আর নতুন শিল্পে ভিন্ন দর নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। প্রতিশ্রুত গ্রাহকের অর্ধেক গ্যাসের দর হবে বিদ্যমান দরের সমান, আর অর্ধেকের জন্য আমদানি মূল্য। বর্তমানে শিল্পে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দর নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা, আর ক্যাপটিভে ৩০.৭৫ টাকা।

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির (জিটুজি) আওতায় এবং স্পর্ট মার্কেট থেকে (উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে) এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। জিটুজি চুক্তিতে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়, যে কারণে ওই দর প্রকাশ করা হয় না। তবে গত আগস্ট মাসে স্পর্ট মার্কেটের চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটারের দাম পড়েছে ৭১ টাকা।

প্রস্তাবিত ফর্মুলা অনুমোদিত হলে প্রতিশ্রুত গ্রাহককে তার ব্যবহৃত অর্ধেক গ্যাসের জন্য ঘনমিটার প্রতি প্রায় ৬০ টাকার মতো পড়তে পারে। অর্ধেকের জন্য বিদ্যমান দর ৩০ টাকা হারে দিতে হবে। নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ৬০ টাকা হারে বিল দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ গত ২৭ ডিসেম্বর এক সভায় এমন সিদ্ধান্ত নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে সম্ভাব্য নতুন গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহকগণ এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে পরিশোধ করবেন। শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে প্রতিশ্রুত (প্রাথমিক সম্মতিপত্র/চহিদাপত্র ইস্যুকৃত) গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে গ্রাহকগণ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যমান শিল্প/ক্যাপটিভ পাওয়ার শ্রেণির মূল্যে প্রাপ্য হবেন। অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে দাম পরিশোধ করবেন।

একইসঙ্গে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির বিদ্যমান গ্রাহক অনুমোদিত লোড অপেক্ষা অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় মূল্যে দাম পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে।

এলএনজি আমদানি মূল্য বলতে দাখিলকৃত বিলের পূর্ববর্তী ৩ মাসের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় ও স্পর্ট এলএনজি ক্রয় বাবদ মোট ব্যয় (এলএনজি ক্রয়মূল্য, রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ, ভ্যাট, ট্যাক্স বিভিন্ন মার্জিনসহ সার্বিক মূল্য) গড় মূল্য বুঝাবে জানানো হয়েছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ওই সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) প্রেরণ করা হবে। এ জন্য শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির বিদ্যমান গ্রাহকগণ অনুমোদিত লোড অপেক্ষা অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহারের তথ্য (জুলাই ২০২৩ হতে অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত) মাসভিত্তিক বিবরণী প্রেরণ করতে বলা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) আব্দুল জলিল স্বাক্ষরিত ওই চিঠি ৬ বিতরণ কোম্পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে,উল্লেখিত প্রস্তাব (গ্যাস ট্যারিফ পুননির্ধারণের প্রস্তাব) বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে প্রেরণের জন্য শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণির বিদ্যমান গ্রাহকগণ অনুমোদিত লোড অপেক্ষা বেশি ব্যবহারের পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য প্রয়োজন। চিঠিতে একটি টেবিল যুক্ত করে দিয়ে সেই অনুযায়ী তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) আব্দুল জলিল বার্তা২৪.কমকে বিতরণ কোম্পানিতে চিঠি প্রেরণের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে ১ টাকা দরে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি থেকে ১.২৫ টাকা দরে, বাপেক্স থেকে ৪ টাকা দরে প্রতি ঘনফুট গ্যাস কেনা হয়। এরপর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও টাল্লোর কাছ থেকে কেনা গ্যাসের সংমিশ্রণে গড় দর দাঁড়ায় ৬.০৭ টাকা ঘনমিটার। দেশীয় এসব উৎস থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে দৈনিক কমবেশি ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। এলএনজি আমদানি থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্য দাড়িয়েছে ২৪.৩৮ টাকা। আর গ্যাসের গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ২২.৮৭ টাকা। এতে করে প্রতি ঘনমিটারে ১.৫৬ টাকা লোকসান হয়েছে পেট্রোবাংলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছিল ৬৫ টাকা, যা আগস্টে (২০২৪) ৭১ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে (সরকারি ও আইপিপি) ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪.৭৫ টাকা ঘনমিটার এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০.৭৫ টাকা ঘনমিটার করা হয়। তার আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছিল। আর ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল।

আর গণশুনানির মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল ২০২২ সালের জুনে। বিদ্যুৎ ৫.০২ টাকা, ক্যাপটিভ ও সার কারখানা ১৬ টাকা, বৃহৎশিল্পে ১১.৯৮ টাকা এবং মাঝারি শিল্প ১১.৭৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নির্বাহী আদেশে দাম বৃদ্ধি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেই নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ সংক্রান্ত আইন বাতিল করে দিয়েছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান একাধিক সভায় বলেছেন, এখন থেকে গ্যাস বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি।

বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্য পাওয়া গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিইআরসিতে প্রস্তাব প্রেরণ করা হবে বলে জানা গেছে। নতুন ফর্মুলা শিল্পে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করবে, বিদ্যমান শিল্প পাবে কমদামে, আর নতুন শিল্প বেশিদামে গ্যাস কিনে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। এতে নতুন শিল্প নিরুৎসাহিত হতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।