লক্ষ্মীপুরের চরে রহস্যঘেরা লোহার 'বয়া'
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের চরউভূতি গ্রামের বিস্তীর্ন চরের মাঝখানে পাশাপাশি দুটি 'বয়া' প্রায় শত বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
লোহার বয়াগুলো দেখতে গোলাকার মোটকা সদৃশ,উপরে রয়েছে রিং এর মতো গোলাকার লোহার হাতল। মাটির ঠিক কত নীচ থেকে এগুলোর অস্তিত্ব ফুটেছে জানা নেই কারও। তবে অসংখ্য মানুষ একত্র হয়েও টেনে তুলতে পারবেনা এগুলো।
কয়েক যুগ আগে 'বয়া'গুলোকে ঘিরে ছিল রূপকথা। তখনকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে মানুষ বয়াগুলোকে অলৌকিক কোন বস্তু হিসেবে বিশ্বাস করতো। সেই বিশ্বাস থেকেই তখন দূরদূরান্তের মানুষ বিভিন্ন মনোবাসনা পূর্ণের নিয়তে এখানে ছুটে আসতো। আয়োজন করে মিলাদ পড়তো, করে টাকা রাখতো আর ভক্তি ভরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতো। কালের বিবর্তনে যখন সমাজ সভ্য হয়ে উঠে,কুসংস্কার কমে যায় তখন থেকে এখানে আর মানুষ কোন মানতে আসেনা। তবে এই বয়াগুলোকে ঘিরে এখনো মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। প্রতিদিন দূর এলাকার কোননা কোন মানুষ এগুলো দেখতে ছুটে আসে এখানে।
স্থানীয়রা জানায়, প্রায় শত বছর আগে এই অঞ্চলে প্রমত্তা মেঘনা বহমান ছিল। এখানে নদীটির দৈর্ঘ্য ছিল ৭ মাইল আর প্রস্থ ছিল ১ মাইল। নদীতে বড়বড় জাহাজ চলাচল করতো এই জায়গার উপর দিয়ে। এরপর নদীটি ক্রমে পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে এদিকে চর দিয়ে যায়। নদী থাকাকালে জাহাজ চলাচলের দিকনির্দেশনার জন্য এদিকে কয়েকটি বয়া ফেলা হয়। চর দেওয়ার পর এই দুইটি বয়া এখানে মাটি চাপা পড়ে যায়। ধীরে ধীরে মাটি সরে গিয়ে বয়াগুলোর অস্তিত্ব ফুটে উঠে।
তবে একসময় মানুষ মনে করতো এই বয়া দুটো এখানে আসার পর থেকেই নদী সরে যায় এখান থেকে। তাই মানুষ অলৌকিক ভেবে এগুলো ঘিরে মানত আর মিলাদ করতো। এসবগুলোও অনেক পুরান কাহিনী। যেহেতু বয়াগুলো মানুষের কাছে ছিল রহস্যাবৃত। তাই এগুলো নিয়ে রূপকথাও ছিল মুখেমুখে। যার কারনে এখানে এই চরটির নামও বয়াগুলোর সাথে মিল রেখে মুখে মুখে রটে যায় "বয়ার চর"।
রহস্যঘেরা এই বয়া দুটি নিয়ে স্থানীয়দের কাছে কৌতুহলের শেষ নেই। এগুলো কীভাবে কোথা থেকে আসলো অনেকেরই জানা নেই। স্থানীয় অনেক বয়স্করাও ছোটবেলা থেকেই গোলাকার এই দুটি বয়া দেখে আসছেন এখানে। আর বাপ-দাদার মুখ থেকেই শুনে আসছেন এগুলোকে ঘিরে নানান রহস্যময় কাহিনী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়,এক সময় লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, তেওয়ারীগঞ্জ, কুশাখালীসহ আশপাশ এলাকা নদী ছিল। তৎকালীন নোয়াখালী জেলার কুশাখালীর ফরাশগঞ্জ ছিল নৌ-বন্দর। ফরাশগঞ্জ নৌ বন্দরে বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। জাহাজ ভিড়াবার জন্য ব্রিটিশরা এ অঞ্চলে কয়েকটি বয়া স্থাপন করে। সেগুলোর মধ্যে এ দুটি বয়াও ছিল। নদী সরে গিয়ে এলাকায় চর জেগে তখন বয়াগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। তবে কালের বিবর্তনে সেগুলোর ওপর থেকে মাটি সরে গিয়ে ওপরের অংশ দৃশ্যমান হয়।
স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব আব্দুল আলী বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকেই এখানে বয়াগুলো দেখে আসছেন। বাপ-দাদাদের মুখে শুনেছেন, তৎকালে অনেক দূর থেকে মানুষ বিভিন্ন নিয়তে এখানে আসতো। মোমবাতি জ্বালাতো, ধূপ পোড়াতো। মিলাদ পড়তো শিরনি বিতরণ করতো। মানত করে টাকা দিত। অনেক বছর এগুলো লাল কাপড় দিয়ে মানুষ ঘিরে রেখে বিশেষভাবে যত্ন নিত। মানত করে এখানে রেখে যাওয়া টাকা পয়সা এলাকার দুষ্ট পোলাপান নিয়ে যেত বলেও জানান তিনি।
এসময় তিনি আরও জানান, বয়াগুলো এখানে আসার পর থেকেই এদিকে আস্তে আস্তে চর জেগে উঠে। এ ধরনের বিশ্বাস ছিল তখন মানুষের মনে।
মমিন উল্যাহ নামে স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ একজন বাসিন্দা বলেন, ১৯৬০ সালের আগে এ চরে তেমন কোনো বসতি ছিল না। নদীর জেগে উঠা চরে ফসল চাষ হত। তখন এ বয়াগুলো লোকজনের নজরে পড়ে। এরপর থেকে বয়াগুলো এভাবেই পড়ে আছে। বয়ার নামে এ এলাকার নাম ‘বয়ারচর’ হয়েছে।
মোহাম্মদ শাহজাহান নামের একজন বলেন, ছোটবেলা থেকে বয়া দুটি দেখে আসছি। অতীতে বয়ার ওপর লোহার তৈরি খাঁচা ছিল। অনেকটা টাওয়ারের উচ্চতার মতো ছিল। কিন্তু সেগুলো কেউ হয়তো নিয়ে গেছে। এখন বয়া দুটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। লোহাগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক সানাউল্যা সানু বলেন, ৭৫ বছর পূর্বে লক্ষ্মীপুর-রামগতি বেড়ী বাধ হওয়ার পর মেঘনা নদী এদিকে চর দিয়ে ৩৫ মাইল পশ্চিমে সরে যায়। এখানে নদী থাকাকালীন বয়াগুলো জাহাজ চলাচলের নির্দেশিকা হিসেবে ফেলা হয়। পানির উপর ভেসে থাকা বয়াগুলোর কোনটাতে লাল আর কোনটাতে সবুজ রঙের বিশেষ বাতি জ্বলতো। যা জাহাজ চলাচলের জন্য বিপজ্জনক ও বিপদমুক্ত পথের নির্দেশনা দিত।
উল্লেখ্য, বয়া হলো নেভিগেশন ইকুয়েপমেন্ট। এগুলো লোহার তৈরি শিকল ও অ্যাঙ্কর দিয়ে আটকানো থাকে।