শিল্প জগতের রত্ন রতন টাটার ব্যতিক্রমী জীবন

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রতন টাটা

রতন টাটা

ভারতের শিল্প জগতের অনন্য রত্ন টাটা গ্রুপের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান রতন টাটা মারা গেছেন। বুধবার (৯ অক্টোবর) মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

শিল্পপতি হিসেবে ৮৬ বছর বয়সী রতন টাটার যতটা নাম, তিনি ঠিক ততটাই পরিচিত তার জনহিতৈষী কাজের জন্য। তার সাফল্যের কাহিনির গভীর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিকভাবে ভারতের অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভারতীয় ব্যবসায়ী জগতের নেতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

রতন টাটা ২০১২ সালে অবসর নিয়েছিলেন, তার আগে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিলেন ‘টাটা গ্রুপ’র চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। বিতর্কহীন এই প্রবীণ শিল্পপতি, তার ব্যবসায়িক দক্ষতা, দূরদৃষ্টি এবং কঠোর কর্ম সংস্কৃতির জোরে পারিবারিক ব্যবসাকে পরিণত করেছেন এক আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে। তবে, এতকিছু সত্ত্বেও, কোনোদিন তার নাম ওঠেনি বিশ্বের প্রথম ১০ কি ২০ জন ধনকুবেরের তালিকায়। যে তালিকায় অম্বানি উঠলেন না, আদানি উঠলেন, তাই নিয়ে আলোচনা হয়। আসলে, তার রোজগারের অধিকাংশটাই যেত জনহিতের কাজে। আর সেই কারণেই ১৪০ কোটির মানুষের দেশে তার মতো সম্মানীয় ব্যবসায়িক নেতা আর একজনও নেই।

১৯৩৭ সালে বিখ্যাত টাটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রতন টাটা। তার বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছিল। তাকে বড় করেছিলেন তার ঠাকুমা। রতন টাটাকে ‘রত্ন’ হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে তার অবদান সব থেকে বেশি। রতন টাটা একবার বলেছিলেন, আমার ঠাকুমা আমাদের যে কোনও মূল্যে মর্যাদা বজায় রাখতে শিখিয়েছিলেন। এই মূল্যবোধ আজ পর্যন্ত আমার সঙ্গে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচার ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি এবং হার্ভার্ড অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের ডিগ্রি অর্জন করার পর, মোটা টাকার চাকরির ডাক এসেছিল আইবিএম থেকে। কিন্তু, সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন রতন টাটা। বদলে, ১৯৬২ সালে টেলকো সংস্থায় সামান্য কর্মী হিসেবে কাজ করা শুরু করেছিলেন। বেলচা ব্লাস্ট চুল্লিতে দলের সদস্য হিসেবে বেলচা দিয়ে চুনাপাথর তুলতে হত। এরপর টাটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থায় বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন রতন টাটা। অবশেষে ১৯৭১ সালে ন্যাশনাল রেডিয়ো অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বা নেলকোর ডিরেক্টর হন। শিক্ষানবিশ থেকে ডিরেক্টর হতে তার নয় বছর লেগেছিল, কিন্তু তিনি কঠোর পরিশ্রম করা থেকে কখনই পিছিয়ে যাননি। আর সেই কারণেই সাধারণ মানুষের জীবনের বাস্তবতা ধরতে তার কখনও অসুবিধা হয়নি।

ভারতের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে টাটা ব্র্যান্ডের কোনও পণ্য বা পরিষেবা নেই। টাটার কোনও পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহার করেনি এমন কোনও ভারতীয় পাওয়া কঠিন। নুন থেকে মোটরগাড়ি, ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে টাটা ব্র্যান্ড। টাটা ব্র্যান্ডের এই সর্বব্যপ্তি ঘটেছিল রতন টাটার সময়েই। ১৯৯১ সালে, জেআরডি টাটার হাত থেকে টাটা সন্স এবং টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রতন টাটা। সেই সময় থেকেই তিনি টাটা গ্রুপের পুনর্গঠন শুরু করেছিলেন। একই সময়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে লেগেছিল উদারীকরণের হাওয়া। রতন টাটার নেতৃত্বে বিশ্বায়নের বাজারে দ্রুত বেড়েছিল টাটা গোষ্ঠী।

টেটলি, কোরাস, জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার, ব্রুনার মন্ড, জেনারেল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট, ডেইউ – নতুন সহস্রাব্দে একের পর এক বড় সংস্থা অধিগ্রহণ করেছে টাটা গোষ্ঠী। রতন টাটার বিচক্ষণ নেতৃত্বে এই সাহসী পদক্ষেপগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল টাটা গোষ্ঠীকে। ১০০টিরও বেশি দেশে পৌঁছে গিয়েছিল টাটা। বিশ্বজুড়ে হোটেল, রাসায়নিক সংস্থা, কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এবং শক্তি সংস্থা এসেছিল টাটা গোষ্ঠীর আওতায়। ঝুঁকি নিতে তিনি কখনও পিছিয়ে আসেননি। তিনি বলতেন, সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল কোন ঝুঁকি না নেওয়া।

ব্যবসায়িক লাভের বাইরেও কিছু করার কথা ভাবতেন রতন টাটা। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি অটুট প্রতিশ্রুতি ছিল তার। ২০২১-এ ভারতের ধনীদের তালিকায় তিনি ছিলেন ৪৩৩তম স্থানে। কারণ ভারতের সবথেকে বড় সমাজসেবীদের একজনও ছিলেন রতন টাটা। ভারতের অন্যতম বৃহৎ দাতব্য সংস্থা হল টাটা ট্রাস্ট ফাউন্ডেশন। শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, গ্রামোন্নয়ন – সব ক্ষেত্রে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে টাটা ট্রাস্ট। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এবং বিভিন্ন আইআইএম ক্যাম্পাসে অর্থ প্রদান করেছে টাটা ট্রাস্ট। কোভিডের সময় অবলীলায় ব্যক্তিগতভাবে ৫০০ কোটি টাকা দান করেছিলেন রতন টাটা। মুম্বাইয়ে ২৬/১১ জঙ্গি হামলার পর, হতাহতদের পরিবারদের পুনর্বাসনে সাহায্য করার জন্য ‘তাজ পাবলিক সার্ভিস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ গঠন করেছিলেন তিনি।

সাধারণ জীবনযাপনের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি। ভারতের মহীরুহ শিল্পপতির ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও অবশ্য কম চর্চা হয়নি। কেন তিনি আজীবন অবিবাহিত ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বার বার।

রতন টাটা তার প্রেমজীবনের কথা প্রকাশ্যে এনেছিলেন নিজেই। জানিয়েছিলেন, তার মনের দরজায় প্রেম কড়া নাড়িয়েছিল চারবার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা পূণর্তা পায়নি। তাই এর পর আর বিয়ের কথা ভাবেননি তিনি। মনপ্রাণ সব দিয়েছিলেন টাটা গোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিকে।

তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তার কোনও প্রেমই বিয়ের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। তবে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত তার জন্য সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ তিনি যদি বিয়ে করতেন তা হলে নাকি পরিস্থিতি খুবই জটিল হয়ে যেত।

কুকুর ও অন্যান্য পোষ্যদের প্রতি, তার অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। টাটা সন্সের গ্লোবাল হেডকোয়ার্টার, বম্বে হাউসে বেশ কিছু পথকুকুর থাকে। তাদের দেখাশোনা করে টাটা সন্স সংস্থা।