সব লোকসান রাষ্ট্রের, লাভ শুধুই ওরিয়নের
২০১০ থেকে চলতি বছর। হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণ থেকে ব্যবস্থাপনা, সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়ম চলমান। দেশের সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভারটি ঘিরে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন গ্রুপের ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম ওই প্রকল্প দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় ৪টি ব্যাংকসহ মোট ৬টি ব্যাংক থেকে ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখন চরম লোকসানের মুখে পড়েছে। গত ১৪ বছরে শুধু নির্মাণকাজ বা ব্যাংকঋণ নয়, রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে ফ্লাইওভারের টোল আদায়েও। ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রতিবছর টোল থেকে ৩৫০ কোটি টাকা আদায় করলেও কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে মাত্র ১৭৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতিবছর হানিফ ফ্লাইওভার থেকে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে রাষ্ট্র। একইভাবে অর্থ লোপাট হচ্ছে এখনো। অর্থাৎ ওরিয়নের আগ্রাসনে সব লোকসান রাষ্ট্রের। তেমনিভাবে সীমাহীন অপকর্মের মাধ্যমে সব লাভ শুধুই ওরিয়নের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংকঋণ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণভাবে পিপিপির মাধ্যমে ‘মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার' নামে বাংলাদেশের দীর্ঘতম ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রথমবার রাষ্ট্রচালিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান (ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার) ইতোমধ্যেই দুবার ঋণের পুনঃতফসিল করেছে এবং বর্ধিত খরচ ও কম আয়ের কারণ দেখিয়ে পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রার সময় তিন বছর অতিক্রম করেছে।
বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ঠিকাদারদের ব্যয়ের প্রাক্কলন বা ফ্লাইওভার থেকে আয়ের কোনো নজরদারি করা হয়নি। ২০১০ সাল থেকে ওই ফ্লাইওভারে মোট ছয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এগুলো হলো রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। এ ছাড়া ইনভেষ্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এবং বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকও বিনিয়োগ করে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চারটি ব্যাংক মোট অর্থের বেশির ভাগ অর্থাৎ ২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ২০১০ সাল থেকে তিনটি ধাপে ঋণের অর্থ বিতরণ করা হয়েছিল। শর্ত ছিল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সাল থেকে প্রথম ধাপের লভ্যাংশ পরিশোধ করবে। কিন্তু ব্যাংকের বিনিয়োগের বিপরীতে কোনো লভ্যাংশ দেননি ওরিয়নের ওবায়দুল করিম। বিনিয়োগের বিপরীতে ২০১৬ সালেও কোনো লভ্যাংশ পায়নি ব্যাংকগুলো।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের অনুকূলে অগ্রণী ব্যাংক থেকে মোট ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০০ কোটি টাকা ঋণ এবং বাকি টাকা বিনিয়োগ হিসেবে দিয়েছে ব্যাংকটি। এই বিনিয়োগ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। তবে ব্যাংকটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ঋণকে শ্রেণিবদ্ধ করেনি। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এটিকে মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের মোট পাওনা ছিল ৭০৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, যা ব্যাংকের মোট পরিশোধিত মূলধনের ৩২ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এটি পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশ ১৫ শতাংশ একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করেছে। তা ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ঋণখেলাপি হওয়া দুটি কোম্পানির মালিক ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের আরেক পরিচালককে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে ঋণ ও বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও ব্যাংকগুলো ওই বিনিয়োগকে শ্রেণিবদ্ধ করেনি এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানও (ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লভ্যাংশ পরিশোধ করেনি। কিন্তু প্রভাবশালী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী সময়ে দুবার ঋণ পুনঃতফসিল করে। একবার ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এবং অপরটি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। দ্বিতীয় পুনঃতফসিল অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান (ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার) ২০১৭ সাল থেকে সুদ এবং নিয়মিত লভ্যাংশ দেওয়ার কথা। এর পরও কোনো রকম সুদ ও লভ্যাংশ পরিশোধ করেননি ওরিয়নের ওবায়দুল করিম।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই ফ্লাইওভারে অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা করে, রূপালী ব্যাংক ৫৫০ কোটি টাকা এবং জনতা ব্যাংক ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ব্যাংকগুলো ফ্লাইওভারে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ হারে সম্পূর্ণ রূপান্তরযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ারের বিপরীতে, ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ হারে সম্পূর্ণরূপে পরিশোধযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার এবং ১৬ শতাংশ লভ্যাংশ হারে প্রস্তাবিত পাবলিক ইস্যুর বিপরীতে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। প্রকল্পের ঠিকাদার ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড বিনিয়োগের বিপরীতে নির্ধারিত লভ্যাংশের হার কমানোর পাশাপাশি মূল অর্থ প্রদানের সময়কাল বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোর প্রতি আবেদন করে।
ঠিকাদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে লভ্যাংশের হার ও পরিশোধের মেয়াদের পরিকল্পনা সংশোধনও করে। নতুন লভ্যাংশের হার পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ারের বিপরীতে ১০ শতাংশ পুনরুদ্ধারযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার এবং প্রকল্পে অর্থায়নের বিপরীতে ১২ শতাংশ রিসেট করা হয়েছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সঞ্চিত লভ্যাংশ চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে ওরিয়ন মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল থেকে প্রতিবছর অন্তত ৩৫০ কোটি টাকা আদায় করলেও কাগজে-কলমে তা দেখানো হয় ১০৫ থেকে ১৭৬ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং কিছু ব্যক্তিগত গাড়ির টোল আদায় করেও তার হিসাব দেওয়া হয়নি। এই হিসাব সিটি করপোরেশন ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীদের কাছে সব সময় আড়াল করা হচ্ছে বলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।