সুগন্ধা ট্রাজেডির ৩ বছর: এখনো দগদগে প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি
ঝালকাঠীর সুগন্ধা নদীতে অভিযান ১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তিন বছর আজ। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনায় এদিন প্রাণ হারিয়েছিল ৪৯ জন যাত্রী। ভয়াবহ সুগন্ধা ট্রাজেডির তিন বছর অতিবাহিত হলেও সেই রাতের স্মৃতি এখনো দগদগে ভুক্তভোগীদের কাছে। আবার অনেক পরিবারই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন দিন কাটাচ্ছে চরম অনিশ্চয়তায়। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অসহায় অস্বচ্ছল পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিলেন জেলা প্রশাসক।
২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসে বরগুনাগামী অভিযান ১০ লঞ্চ । লঞ্চটি ২৪ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পৌঁছায় এসময় অনেকেই ছিল গভীর ঘুমে মগ্ন। হঠাৎ ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহুর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা লঞ্চে। আগুনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে লঞ্চটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে চালক। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচায়। গভীর ঘুমে মগ্ন থাকা কেবিন রুমের যাত্রীসহ আগুনে পুড়ে নিহত হয় ৪৯ জন। ঘটনার পর ২৫টি মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হলেও অজ্ঞাত পরিচয়ের ২৪ জনকে দাফন করা হয় বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালী গণকবরে। এরপর অজ্ঞাত পরিচয়ে দাফন করা ২৪টি মরদেহ শনাক্তের জন্য পর্যাক্রমে ৫১ জনের নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি‘র ফরেনসিক বিভাগ। এই ২৪ জনের মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে সিআইডির ডিএনএ টেস্টে। এই দুর্ঘটনায় কেড়ে নিয়েছে কারো ভাই, কারো বোন, কারো মা-বাবা আবার কারো প্রিয় সন্তান। অগ্নিকাণ্ডের ৩ বছর পরও স্বজনদের কাছে প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি দগদগ করছে।
অভিযান ১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের দিন সদ্য প্রসবজাত সন্তানকে দেখতে বরগুনার আসছিলেন বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের রিয়াজ হাওলাদার। সুগন্ধা নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামী রিয়াজ হাওলাদারকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন স্ত্রী মুক্তা আক্তার। দুই সন্তান শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে এখন দুর্বিষসহ দিন কাটছে তার। স্বামীকে হারানোর পর থেকেই তাদের জীবনে নেমে এসেছে বিষাদের কালো মেঘ।
মুক্তা আক্তার বলেন, 'আমার ছোড পোয়াডা জন্মের পরপরই ওর বাপরে হারাইছে। আমরা হারাইছি আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। পোয়াগো (ছেলেদের) খাওন পড়ন, শ্বশুর শাশুড়ির ভরপোষণ সবই সবই দেখতো ওর বাপে (রিয়াজ হাওলাদার)। এখন তো মোগো কেউ নাই কিছু নাই। ছেলেরা বড় হচ্ছে খরচ বাড়ছে। কতোজন কতো আশ্বাসই না দেলো কিন্তু কোন আশ্বাসেই কাজ হলো না। ডিসি অফিস দিয়া একটু সহযোগীতা করলেও আর কেউ ফিরে তাকায়নি আমাদের দিকে। যতই দিন যাচ্ছে ততই কষ্টের দিন আসছে।'
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, 'এতো বড় লঞ্চ অগ্নিকাণ্ড দক্ষিণাঞ্চলবাসী আর কখনো দেখেনি। এই অগ্নিকাণ্ডে কেউ হারিয়েছে মা-বাবা, কেউ হারিয়েছে ভাই-বোন, কেউ হারিয়েছে প্রিয় সন্তান। এমন অনেক পরিবার আছে যাদেও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নিহত হয়েছে এই অগ্নিকাণ্ডে। এসকল পরিবারগুলো নামমাত্র সহযোগীতা করা হলেও এদের পুনর্বাসনের জন্য স্থায়ী কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে দাবি থাকবে যেসকল পরিবার অসহায় ও অস্বচ্ছল রয়েছে তাদের তালিকা করে সরকারিভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।'
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, 'নিহত আহত প্রত্যেক পরিবারকেই সরকারিভাবে সহযোগীতা করা হয়েছে। তারপরও স্মরণকালের ভয়াবহ এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত অস্বচ্ছল, অসহায় পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।'