দুই বছর আগে পিতার মৃত্যু আর প্রায় দুই মাস ধরে মা কারাগারে। দিশেহারা এতিম নাতিদের নিয়ে নানা ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে।
দুই বছর আগে স্বামী আমিন শেখের মৃত্যুর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে একাই মা-বাবা দুজনের দায়িত্ব পালন করছিলেন বিধবা পপি খাতুন।
গত ২ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে পপি খাতুনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারপর আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তখন পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন মৃত আমিন শেখের ঋণের দায়ে মামলা রয়েছে।
জানা গেছে, এই মামলায় আমিন-পপি দম্পতির শিশু তিন সন্তান আইরিন (১০), আহমাদুল্লাহ (৬) আর জানাতুন নাঈমা (৪) নাবলক এতিম তিন শিশুও পিতার ঋণের দায়ে ব্র্যাক ব্যাংকের দায়ের করা অর্থ ঋণের মামলার আসামি।
মায়ের জেলে যাবার পর থেকে ওই তিন শিশু দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। আসামির হয়ে সব সময় পুলিশের ভয়ে থাকে তারা।
এতিম শিশুদের নিয়ে এমনিতেই দিশেহারা অবস্থা তার ওপর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পপি খাতুন জেলে যাবার পর নানার কাছে আশ্রয় পেয়েছে তিনটি অবুঝ শিশু। তাদের বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায়।
পিতাহারা সন্তানেরা ঋণের মামলায় কারাগারে থাকা মা কে জেল থেকে মুক্তির জন্য তারা পাগলপারা।
একদিকে বাবা হারানোর শোক, মা জেলে। অন্যদিকে সুদে আসলে ২৯ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণের ওয়ারিশ সূত্রে মা, দাদির সাথে অর্থ ঋণের মামলায় আসামি তারাও।
অসহায় এতিম তিন শিশু, যারা এখনো ঠিকমতো টাকা, ঋণ, লেনদেনের অর্থই বোঝে না। বয়স লুকিয়ে তাদেরও করা হয়েছে আসামী।
পিতার মৃত্যুর পর বেহাত হয়ে গেছে বাবার ব্যবসা। এদিকে পপির জামিন করাতে আদালতে ঋণের দায়ের ২৫ শতাংশ ৭ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
পপির বাবা বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের বান্দুগ্রামের বৃদ্ধ সিরাজ শেখ বলেন, নিজেরই সংসার চলে না তার উপর যুক্ত হয়েছে মেয়ের এতিম নাবালক তিন সন্তান। দিনমজুর শশুরেও সাধ্য নাই মৃত জামাতার ঋণ পরিশোধ করার।
তিন বলেন, আমার মেয়ের জামাই বোয়ালমারী বাজারের পোল্ট্রি মুরগী ব্যবসায়ী আমিন শেখ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর পর জানতে পারি সে ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি বোয়ালমারী শাখা থেকে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ৩০ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করে । এর মধ্যে জীবিত থাকা অবস্থায় কিস্তিতে সুদে আসলে ৬ লাখ ২১ হাজার ৩৭৮ টাকা পরিশোধ করে।
আমিনের মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর ফরিদপুর জেলা জজ ১ম অর্থঋণ আদালতে আমার মেয়ে পপি খাতুন, তার তিন এতিম নাবালক শিশু সন্তানসহ, আমিন শেখের মা সালেহা বেগম ও মো. চুন্নু মিয়া নাম উল্লেখ পূর্বক ছয় জনের নামে মামলা করে।
মামলার বিষয়ে কিছুই জানতো না আসামিরা। মামলার বিবরণে ফরিদপুর জজ আদালতের বাদির পক্ষের আইনজীবী তার স্বাক্ষরিত আর্জিতে বিবাদীগণের নামে ৯ ডিসেম্বর ২০২১ সালে লিগ্যাল নোটিশ জারি করেছেন বলে দাবি করেছেন।
অথচ ঋণ গৃহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তারও এক বছর পর ২০২২ সালে।
ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি বোয়ালমারী শাখা আমিন শেখের দুই এতিম নাবালক মেয়ে ও নাবালক ছেলের বয়স গোপন করে তাদেরও মামলার আসামি করেছে।
মায়ের গ্রেপ্তারের পর থেকেই একই মামলার আসামি তিনটি এতিম নাবালক শিশু সারাক্ষণ শঙ্কা ও পুলিশে ধরে নেওয়ার আতংকের মধ্যে থাকে।
পপি খাতুনের আত্মীয় হুমায়ুন কবির বলেন, অবুঝ তিনটি শিশুকে ঋণের দায়ী হিসেবে আসামি করা হয়েছে। এরা নাকি জামিনদার হয়েছিলো। এরা ঋণের কী বুঝে। আদালতের নিকট আবেদন মৃত ঋণ গ্রহীতার অসহায় ওয়ারিশদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে ঋণ মওকুফ করে তাদেরকে দায় মুক্ত করা হোক।
এই বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংক বোয়ালমারী শাখার ব্যবস্থাপক রাসেল আহমেদ বলেন, ঋণ গ্রহীতা মৃত আমিন শেখ আমাদের শাখা থেকে ত্রিশ লাখ টাকা ঋণ নেয়। আমাদের ব্যাংকের শর্ত ও নিয়মের মধ্যে থেকেই চলমান ব্যবসার অনুকূলে ঋণ দেওয়া হয়েছে। শর্তাবলী মেনেই ঋণের টাকা অনাদায়ে জামিনদার ও ওয়ারিশ গণের নামে মামলা হয়েছে।
বিবাদী পক্ষের আইনজীবী এ্যাড. মেহেদী হাসান বলেন, মৃত আমিন শেখের অপ্রাপ্ত বয়সী তিনটি অবুঝ শিশুকে এ মামলায় ওয়ারিশ সূত্রে আসামী করা হয়েছে। তারা ওয়ারিশ হলেও বয়স হওয়ার আগে পিতার সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের আসামি করা আইন সমর্থন করে না। শিশুদের বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছে তারা প্রত্যারণার আশ্রয় নিয়ে আদালতকে ভুল তথ্য দিয়েছে। এটা আদালত অবমাননার সামিল।