মহাসড়কে বন্যার পানিতে তীব্র যানজট, উদ্বেগ-আতঙ্কে ফেনীবাসী
বন্যা পরিস্থিতিস্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী। জেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা বন্যা কবলিত। এতে প্রায় আড়াইলাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছেন। ইতোমধ্যে জেলার পল্লী বিদ্যুতের সব গ্রাহক বিদ্যুৎহীন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ফেনীর ফুলগাজী-পরশুরামসহ প্রায় সব উপজেলা। প্লাবিত হয়েছে ফেনী শহর।
ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে পানির তীব্র স্রোতের কারণে দেখা গিয়েছে ভয়াবহ যানজট। গাড়ির ধীরগতির কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মুখী যানবাহনগুলোকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। বন্যার পানি কোথাও কমলেও কোথাও বাড়ছে। উদ্বেগ আতঙ্কে সময় পার করছে ফেনীবাসী।
শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সরেজমিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজকুঞ্জরা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে যানবাহন। মহাসড়ক দিয়ে বন্যার পানি একদিক থেকে অন্যদিকে প্রবাহিত হওয়ার কারণে যানচলাচল ব্যহত হচ্ছে। যাত্রীবাহী গাড়ির যাত্রীসহ মালবাহী গাড়িগুলো দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে মহাসড়কে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন চালক ও যাত্রীরা।
স্থানীয়রা জানান, বন্যার পানি ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়নের লাঙ্গলমোড়া, সাতানীপাড়া ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পূর্ব দিকের বন্যার পানি মহাসড়ক পশ্চিম দিকে নিজকুঞ্জরার দিকে প্রবেশ করছে। পানির স্রোতের তীব্রতার কারণে গাড়ি চলাচল করতে পারছে না। এছাড়াও মহাসড়কের ফেনী অংশের বিভিন্ন জায়গায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ঝুঁকি এড়াতে স্বেচ্ছাসেবকরা ত্রাণ পরিবহন গাড়ি ব্যতীত অন্য গাড়ি চলাচল করতে নিরুৎসাহিত করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ইশতিয়াক চৌধুরী জানান, বন্যার পানিতে আমাদের এলাকার পানি গলা পর্যন্ত। কিছু মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়েছে, তবে অনেকে এলাকায় অবস্থান করছে। লাঙ্গলমোড়ার পানি নিজকুঞ্জরার দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, যার কারণে মহাসড়কে পানির তীব্রতা বেশি। ফলে গাড়ি চলাচল করতে না পেরে দীর্ঘক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ইয়াকুব নামে আরেকজন জানান, বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সকাল থেকেই গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে দেখছি। অনেক ড্রাইভার ও যাত্রীরা অনেক ভোগান্তিতে আছে। অনেকে না খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে। স্থানীয়রা তাদের সহযোগিতা করছে।
আবদুর রহমান নামে একজন ট্রাক চালক বলেন, বৃহস্পতিবার রাত দুইটা থেকে জ্যামে বসে আছি। বন্যার পানি রাস্তায়, গাড়ি যাওয়ার মত অবস্থা নেই। চট্টগ্রাম থেকে যাচ্ছিলাম, এমন অবস্থা জানা ছিল না। রাস্তায় বসে আছি, খাওয়া দাওয়া কিছু নেই আমাদের।
উম্মে কুলসুম নামে এক যাত্রী বলেন, আমি চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে হেঁটে বারৈয়ারহাট চলে এসেছি। রাস্তায় অনেক বেশি জ্যাম। বন্যার পানির কারণে গাড়ি যেতে পারছে না। আমার মতো বহুযাত্রী দুর্বিষহ সময় পার করছে।
ঢাকা থেকে আসা এক যাত্রী বলেন, চৌদ্দগ্রামের পর থেকে পানি। এদিকে ফেনীর লালপোল অংশে গলা সমান পানি। গাড়ি কোনোভাবে সামনে যেতে পারছে না। পানির স্রোতের কারণে হেটেও যাওয়া সম্ভব ছিল না। পরবর্তীতে স্পিড বোটের সহযোগিতায় বাড়ি এসে পৌঁছেছি।
মহাসড়কে কাজ করা একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, বন্যার পানির যে স্রোত, গাড়ির জন্য এটি ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে৷ যার কারণে আমরা গাড়ি যেতে দিচ্ছি না নিরাপত্তার জন্য। তবে পানি কিছুটা কমলে থেমে থেমে কিছু যেতে দিচ্ছি।
এদিকে মহাসড়কে গাড়ি অবস্থান করায় বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বন্যা কবলিত এলাকার অধিকাংশ মানুষ জানিয়েছেন মহাসড়কে ডাকাতি হচ্ছে। স্থানীয়দের সতর্ক করছেন তারা।
তবে একদিকে ডাকাতির আতঙ্ক, অন্যদিকে বন্যার পানি, সবকিছু মিলিয়ে ভয়ানক পরিস্থিতি পার করছেন বলে জানিয়েছেন ফেনীর স্থানীয়রা।
সায়েম উল্ল্যাহ নামে একজন বলেন, এলাকার মসজিদের মাইকে বলা হয়েছে, ডাকাত প্রবেশ করেছে, সবাইকে সতর্ক থাকতে। মহাসড়কেও ডাকাতির সংবাদ শুনেছি। পরবর্তীতে একাকার সবাই মিলে গলাসমান পানিতে রাতভর পাহারা দিয়েছি। একদিকে পানিতে আমরা অন্যদিকে ডাকাতির সংবাদ সবমিলিয়ে আতঙ্কে রাত পার করছি।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জেলার কোথাও বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বন্ধ। জেলার বেশিরভাগ এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। কোথাও একতলা সমান পানি, কোথাও গলা অব্দি। উদ্ধার কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ স্বেচ্ছাসেবকরা। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় ফেনীতে দেয়া হচ্ছে ত্রাণ সহায়তা। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার পানিতে কয়েকজনের মৃত্যুর সংবাদ শোনা গেছে। ইতোমধ্যে ফেনী পরিদর্শন করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
উল্লেখ্য, ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি পানির স্রোতে মুহুরী-সিলোনিয়া ও কহুয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ও বেড়িবাঁধ ভেঙে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার শিকার হয় ফেনী জেলা।