লক্ষ্মীপুরে বাড়ছে উজানের পানি, আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ
বন্যা পরিস্থিতিগত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে লক্ষ্মীপুরে কয়েক লাখ মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়ে। শনিবার (২৪ আগস্ট) বৃষ্টি থামলেও নামছেনা জলাবদ্ধতার পানি। উল্টো জেলার শহরসহ ৫টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাড়তে শুরু করেছে উজানের পানির চাপ। খাল-বিলগুলো দিয়ে তীব্র বেগে পানি ঢুকছে। বৃষ্টির পানি কোথাও কোথাও দুই ফুট পর্যন্ত বেড়ে নিম্নাঞ্চলের পাশাপাশি নতুন নতুন উচু এলাকাগুলো প্লাবিত হচ্ছে। উপায় না পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছে পানিবন্দি পরিবারগুলো।
সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, কুশাখালী, কমলনগর উপজেলা, রামগতি ও রামগঞ্জ উপজেলায় ১৮৫টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া এসব এলাকার বেশীরভাগ সরকারী প্রাথমিক, মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলো বন্যার্তদের আশ্রয়ের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
সরেজমিনে লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের পুলিশ লাইন্স, জকসিন, লাহারকান্দি ইউনিয়নের আটিয়া তলি, চাঁদখালি, মান্দারি, দিঘলী, দত্তপাড়া, চন্দ্রগঞ্জ ও ভবানিগঞ্জ ইউনিয়নসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় গতিবেগে পানি বাড়ার চিত্র দেখা যায়।
এসব এলাকার রাস্তাঘাটের কোন অংশে হাটু পানি আবার কোন অংশে কোমড় সমান পানি। এর মধ্যে চলাচল করেত গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন যানবাহনসহ স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, সর্বত্রই এখন জলাবদ্ধতা, খাল বিল দিয়ে ভারত থেকে নির্গত পানি জেলায় চাপতে শুরু করেছে। গত ২১-২২ দিন টানা বৃষ্টিপাতে তাদের ঘরবাড়িতে হাটু সমান পানিতে ডুবেছে। শুক্রবার থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত তেমন কোন বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু উল্টো পানি বেড়ে কোমড় সমান ডুবে গেছে। বাড়িঘর ছেড়ে তাদের অনেকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রসহ দূরের স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। জেলা প্রশাসন অথবা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ত্রান সহায়তা দেয়া হয়নি বলে জানান অনেকেই।
সদর উপজেলার চাঁদখালি গ্রামের ষাটোর্ধ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, '৯৮ এর বন্যা দেখেছি কিন্তু এমনতো দেখি নি। সকালে যেখানে হাটু পানি ছিলো, সেখানে দুপুরে কোমড় সমান পানি। পানি বাড়ায় বাড়ি ঘরে মা-বোন-ঝিরা খুবই কষ্ট করতেছে।'
একই এলাকার দোকানদার রাশেদ বলেন, 'সকালে দোকান ঝাড়ু দিয়ে মুছে গেছি ,দুই ঘণ্টা পর এসে দেখি দোকানের ভেতরে দুইফুট পানি। পেছনের বাড়িঘর সব পানিতে ডুবে গেছে।'
কয়েকজন যুবকের সহায়তায় কোমর সমান পানিতে ঘর থেকে ব্যবহারের ফ্রিজ বের করে পাশের উচু বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন কোহিনুর বেগম। তিনি লক্ষ্মীপুর সদরের লাহারকান্দি ইউনিয়নের আটিয়া তলি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি জানান, 'গত কাল পর্যন্ত বৃষ্টিতে ঘরের ভেতরে হাটু সমান পানি ছিল। ফ্রীজটি নিচে ইট দিয়ে উচু করে রেখেছি। আজকে বৃষ্টি নেই, কিন্তু কোমর সমান পানিতে ডুবে ফ্রীজের নিচের অংশ চালের ড্রাম ডুবে গেছে। কোনমতে ফ্রীজটি পাশের বাড়িতে রেখেছি।'
উত্তর চাঁদখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইসমাইল হোসেন সিরাজী বলেন, 'ভারত থেকে নেমে আসা বন্যার পানি ফেনী-কুমিল্লাহ ও নোয়াখালী হয়ে এখন লক্ষ্মীপুরে ঢুকতে শুরু করেছে। এজন্য বৃষ্টি থামার পারও পানি না নেমে বাড়ছে। এতে আমাদের স্কুলে পানি ঢুকে আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কবে নাগাদ পানি নামে তার কোন ঠিক নেই। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনাও বন্ধ হয়ে গেছে। '
এদিকে চাঁদখালি এ রব বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ২২টি পরিবারের ৯৬জন পানি বন্দি হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে যুগীরহাটের রহিমের বাড়ি থেকে হোসনে আরা বেগম তার পরিবারের ১০জন সদস্য নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তার সাথে খুকি বেগম, মিনোয়ারা বেগম, নয়ন বেগম, কাজলও পরিবার নিয়ে এসেছেন। পানিতে তাদের ঘরের আসবাবপত্রসহ সব ডুবে আছে বলে জানান তারা। পরে ইউনিয়ন থেকে লোকজন তাদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন।
লাহারকান্দি ইউনিয়ের ইউপি সদস্য আবদুল্লাহ আল মুকিম বলেন, এ ইউনিয়নের ১, ৫,৭,৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সবগুলো এলাকায় আজ সকালেই ৬-৮ ইঞ্চি পানি বেড়েছে। ডুবে গেছে অধিকাংশ বাড়িঘর। আজ রাত এ ভাবে থাকলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। প্রশাসনসহ বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে দালাল বাজার মস্তাল মসজিদ এলাকার বাসিন্দা শিক্ষক হাসান মাহামুদ বলেন, তাদের বাড়িতে উঠান ডুবলেও ঘরে উঠেনি পানি। কিন্তু সারাদিনে ঘরের ভেতরে পানি ঢুকে গেছে। বৃষ্টি নেই তবুও বাড়ছে পানি।
এদিকে কমলনগরের চরপাগলা ইউনিয়ন, চর কাদিরা, চর লরেন্স ও রামগতি উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ইউনিয়নগুলো গত ২২ দিন ধরে পানি বন্দি। একইভাবে নোয়াখালী থেকে নেমে আসা পানিতে তাদের বাড়ি ঘরে পানির পরিমাণ ২ ফুট বেড়েছে। তাদের অনেকে যাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুর রহমান বলেন, 'এ উপজেলায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে জীবন-যাপন করছে। আমরা ইতিমধ্যে আমরা পানিবন্দি ৬'শ পরিবারকে সাইক্লোন সেন্টারে পৌঁছাতে সক্ষম হলাম। তাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। যেখানেই আমরা পানিবন্দি মানুষের সন্ধান পাই, সেইখানেই আমরা ছুটে যাই।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বন্যার্তদের সহায়তায় ৫৭৬ মে.টন চাল ও নগদ ১০ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানান, 'যেসব এলাকায় মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। ওইসব এলাকায় আমাদের নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) কাজ করছে। আমরা পানিবন্দি মানুষগুলোকে আশ্রয়ণ কেন্দ্র নেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। নতুন করে যেসব এলাকায় মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে আমরা তাদেরও খোঁজখবর নিচ্ছি।'