ভয়াবহ বন্যা

ফেনীতে চারদিকে অথৈ পানি, দেখা মিলছে নৌকা

  বন্যা পরিস্থিতি
  • মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,ফেনী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফেনীতে চারদিকে অথৈ পানি, ছবি: বার্তা২৪.কম

ফেনীতে চারদিকে অথৈ পানি, ছবি: বার্তা২৪.কম

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা কবলিত ফেনী জেলা। যে শহর প্রতিদিন সকাল হলেই গাড়ির টুংটাং শব্দে মানুষের কোলাহল শোনা যেত, গাড়ির দীর্ঘ লাইনে যানজট সৃষ্টি হতো সে শহরে নেই আগের চিরচেনা রূপ। ফেনীতে ভয়াবহ বন্যার কবল থেকে রেহাই পায়নি জেলা শহরও। সড়কের চারদিকে অথৈ পানি, দেখা মিলছে নৌকা। জরুরি প্রয়োজনে কিংবা নিরাপদ স্থানে যেতে নৌকায় যাতায়াত করছেন সাধারণ মানুষ। নিচতলায় আটকে পড়া অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার আশ্রয়কেন্দ্রে। শহরের মানুষ বলছেন এটি ইতিহাসের নজিরবিহীন ঘটনা।

ফেনী শহর ঘুরে দেখা যায়, ফেনী সরকারি কলেজ রোড, ট্রাংক রোড, শহীদ শহীদুল্লাহ্ কায়সার সড়ক, সদর হাসপাতাল মোড়, একাডেমি এলাকাসহ বেশিরভাগ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছে পানি। এতে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা।

বিজ্ঞাপন

বন্যার পানি কিছু কিছু এলাকায় কমলেও অনেক জায়গায় এখনও রয়ে গেছে। বন্যার পানিতে অধিকাংশ এলাকায় ডুবে যায় নিচতলা বাড়ি। বন্ধ হয়ে যায় বিদুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ। এতে ভোগান্তিতে পড়ে শহরের বাসিন্দারা। বিদ্যুৎ না থাকাতে সুপেয় পানির অভাবে অনেকে না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। এ প্রতিবেদন লেখা অব্দি শহরের কিছু কিছু এলাকায় ৩ দিন পর বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। তবে বেশিরভাগ এলাকয় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন।

শহরের বাসিন্দা সখিনা খাতুন জানান, বাসার নিচে এক কোমর পানি। নিচতলায় মোটর ডুবে গেছে। বিদ্যুৎ নেই, পানি উঠানোর ব্যবস্থা নেই৷ দুইদিন রুটি খেয়ে কাটিয়েছি। এখন কেউ কেউ পানি দিয়ে যাচ্ছে এবং নিজেরা নিচে গিয়ে ব্যবস্থা করে নিয়ে এসেছি৷ এভাবেই দুর্বিষহ সময় কাটছে আমাদের।

বিজ্ঞাপন

মোহাম্মদ শাকিল নামে আরেকজন বলেন, দোকানের সব মালামাল পানিতে ডুবে গেছে। কিছু বের করার সুযোগ ও পাইনি। শহরে এমন অবস্থা জীবনে প্রথম দেখলাম৷ মানুষের হাহাকার নিজের সামনে পর্যবেক্ষণ করলাম। সড়কে নৌকা চলছে, মানুষ পানির অভাবে খেতে পারছেনা। শহরের মানুষও আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছে। নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হয়েছে ফেনী।


আবু ইসহাক নামে ষাটোর্ধ বয়সের একজন রিকশা চালক বলেন, আমার জীবনে আমি এত পানি কোনদিন দেখিনি। গ্রামে বন্যা হতে দেখেছি তবে শহরে এত পানি জীবনে প্রথম দেখলাম। গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার সুযোগ পাইনি।।বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি।

নন্দিতা নামে একজন বলেন, অনেক আত্মীয়স্বজনের কোন খোঁজ পাচ্ছিনা। বাসার নিচে পানি, কারও কোনো খোঁজ নেই। বাসার বিদ্যুৎ নেই, পানির প্রয়োজন নিচে গিয়ে যে আনব সে ব্যবস্থা নেই। ফেনীতে এমন চিত্র জীবনে প্রথম দেখলাম।

ইসরাত জাহান সোমা নামে একজন বলেন, আমার চিরচেনা শহরে কোন কোলাহল নেই। আমার কলেজ মাঠে পানি। যেখানে বসে আড্ডা দিতাম সেখানে পানির স্রোত। দেখে খুব খারাপ লাগছে নিজের শহরের জন্য। শহরে নৌকা চলবে এটি স্বপ্নেও কোনদিন ভাবিনি। ফেনীর মানুষ যে সময়গুলো পার করছে তা জীবনে কোনদিন ভুলবে না।


আইয়ুব আলী নামে একজন বলেন, শহরে পানি উঠলেও হতাহতের খবর শুনিনি।চিন্তা হচ্ছে ফুলগাজী-পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার মানুষের জন্য। কত মানুষের খোঁজ নেই। পানি এখন কমেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও না বোঝা গেলেও, ফেনীতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে।

এদিকে রোববার (২৫ আগস্ট) বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের বন্যাকবলিত ফেনী পরিদর্শন করার কথা রয়েছে।

বন্যাদুর্গত এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্ধার তৎপরতা উল্লেখযোগ্যহারে লক্ষ্য করা গেছে।ফয়সাল মাহমুদ শাওন নামে এক স্বেচ্ছাসেবক জানান, ফেনীর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ছাড়াও ফেনীর বাইরে থেকে আসা হিউম্যান এইডস, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন, ড্রিমটাচ বাংলাদেশ, একজন বাংলাদেশ, ফেনী ক্লাব ঢাকা, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, মাস্তুল ফাউন্ডেশনসহ বেশকিছু সংগঠন স্বউদ্যোগে স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে এবং শুকনো খাবার সরবরাহ করছে।

ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, এ পর্যন্ত সাড়ে ৫০০ টন চাল এবং ১০ লাখ টাকা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় হতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের উদ্ধার কাজ চলমান রয়েছে।

জেলা শহরে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ এসেছে তবে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বন্ধ। জেলার বেশিরভাগ এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। তবে পানির মাত্রা কিছুটা কমে এসেছে। কিছু কিছু এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে তবে অন্য এলাকায় ফের বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ফেনীতে দেয়া হচ্ছে ত্রাণ সহায়তা। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার পানিতে কয়েকজনের মৃত্যুর সংবাদ শোনা গেছে।

উল্লেখ্য,ভারী বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি পানির স্রোতে মুহুরী-সিলোনিয়া ও কহুয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ও বেড়িবাঁধ ভেঙে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার শিকার হয় ফেনী জেলা।পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত স্বজনরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার আছেন।সবধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ায় স্থানীয় গণমাধ্যমর্কর্মীগণেরও সংবাদ সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।